দেয়া। জুম্মাঘরের মাওলানার জন্যে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তিও তিনি ঠিক করেছেন। মাওলানার নাম ইদারিস। বাড়ি ফরিদপুরে। মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তিতে তার ভালোই চলে যায়। মুসলমান গৃহস্থ বাড়ি থেকে তাকে ধান দেয়া হয়। যেকোনো ভালো রান্না হলে তাকে আগে পাঠানো হয়। বিয়েশাদি হলে মাওলানার জন্যে বিশেষ বরাদ্দ থাকে- তবন (লুঙ্গি), পাঞ্জাবি, টুপি, ছাতা।
মাওলানা ইদারিসের সর্বমোট নয়টা ছাতা বর্তমানে আছে। প্রায়ই ভাবেন বুধবার হাঁটে গিয়ে একটা ভালো ছাতা রেখে বাকিগুলি বিক্রি করে আসবেন। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় না। লোকজন তাকে ভালোবেসে ছাতা দিয়েছে, সেই ছাতা কীভাবে বিক্রি করবেন! ইদারিস মাওলানার বয়স ত্ৰিশ। ধবধবে ফর্স গায়ের রঙ। সাধারণের চেয়ে লম্বা। মাথায় সবসময় পাগড়ি পরেন বলে আরো লম্বা লাগে। নিজের ঘরে তিনি লুঙ্গি-গেঞ্জি পরলেও বাইরে লেবাসের পরিবর্তন হয়। চোস্ত পায়জামা, ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি, চোখে সুরমা, পাগড়ি এবং দাড়িতে সামান্য আতর। দাড়িতে আতর দেয়া সুন্নত। নবিজি দাড়িতে আতর দিতেন।
জুম্মাঘরের বারান্দায় রাখা বেঞ্চে মাওলানা ইদারিস বসে আছেন। তার সামনে কাঠমিন্ত্রি সুলেমান ছেলেকে নিয়ে বসা। ছেলে বসে থাকতে পারছে না। ছটফট করছে। সুলেমান এক হাতে ছেলেকে শক্ত করে ধরে আছে।
মাওলানা ইদারিস বললেন, ছেলের নাম কী?
সুলেমান বলল, জহির।
জহিরের সাথে আর কিছু নাই?
সুলেমান বলল, জে আজ্ঞে, না।
মাওলানা বললেন, আজ্ঞে বলতেছ। কেন? কথায় কথায় জ্বে আজ্ঞে বলা হিন্দুয়ানি। হিন্দুয়ানি দূর করা লাগবে। বিলো জে-না।
সুলেমান বলল, জে-না।
মাওলানা বললেন, ছেলের নাম রেখেছি জহির। এটা তো হবে না। জহির আল্লাহপাকের ৯৯ নামের এক নাম। এর অর্থ জাহির হওয়া। আল যাহিরু। নাম বদলাতে হবে। এখন থেকে নাম আব্দুল জহির। এর অর্থ জহিরের গোলাম। অর্থাৎ আল্লাহপাকের গোলাম। বুঝেছ?
জি বুঝেছি। এখন ছেলেকে একটা তাবিজ দিয়া দেন। অতি দুষ্ট ছেলে। বনে জঙ্গলে ঘুরে। হরিবাবুর দিঘিতে মরতে বসেছিল। হরিবাবু ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। ছেলেরে বাচালেন। উনার জন্যে ছেলের জীবন রক্ষা হয়েছে।
মাওলানা ইদারিস বিরক্ত হয়ে বললেন, হরিবাবু তোমার ছেলেকে বাঁচানোর কে? তাকে বাঁচিয়েছেন আল্লাহপাক। মানুষের জীবনের মালিক উনি ভিন্ন কেউ না। বুঝেছ? হায়াত, মাউত, রেজেক, ধনদৌলত এবং বিবাহ এই পাঁচটা বিষয় আল্লাহপাক নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। এই বিষয় মনে রাখবা।
সুলেমান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মাওলানা বললেন, তাবিজ লিখে রাখব, একসময় এসে নিয়ে যাবে।
জে আজ্ঞে।
আবার জে আজ্ঞে?
অভ্যাস হয়ে গেছে, কী করব?
অভ্যাস বদলাতে হবে। ধুতি পরা ছাড়তে হবে। ধুতি হিন্দুর পোশাক। মুসলমানের লেবাস হবে নবিজির লেবাস।
সুলেমান বিড়বিড় করে বলল, এখন আমি যদি পাগড়ি পরে ঘুরি, লোকে কী বলবো?
মাওলানা বললেন, তোমাকে তো পাগড়ি পরতে বলতেছি না। ধুতি পরতে নিষেধ করতেছি। আর যদি পরতেই হয় লুঙ্গির মতো পরাবা। এতে দোষ খানিকটা কাটা যায়।
ছেলের মায়ের জন্যে কি একটা তাবিজ দিবেন?
তার কী সমস্যা?
জঙ্গলে ঘুরে। নিজের মনে গীত গায়।
নামাজ রোজা কি করে?
রোজা করে। নামাজের ঠিক নাই।
নামাজ ছাড়া রোজা আর নৌকা ছাড়া মাঝি একই বিষয়। তারে নামাজ পড়তে বলবা।
জি বলব। সুন্দরী মেয়েছেলে, তার উপরে জিনের নজর পড়ছে কি-না এইটি নিয়া আমি চিন্তিত।
জিনের নজর পড়া বিচিত্র না। তাবিজ লেইখা দিব, চিন্তা করবা না।
সুলেমান উঠে দাঁড়াল। যাবার সময় বেঞ্চে একটা এক আনি রাখল। এমনভাবে রাখল যেন মাওলানার চোখে না পড়ে। মাওলানা সাহেবকে দেখিয়ে নজরানা দেয়া বেয়াদবি, আবার কোনো নজরানা না দিয়ে চলে আসাও বেয়াদবি।
মাওলানা ইদারিস সুলেমান চলে যাওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তার ডানপাশে জুম্মাঘর। নিজের একটা জায়গা। অতি আপন। তাকালেই শান্তি শান্তি লাগে। জুম্মাঘরের অবস্থা ভালো না। টিনের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। একটা দরজা। উইপোকা পুরোপুরি খেয়ে ফেলেছে। বাঁশের দরমা দিয়ে ভাঙা দরজা বন্ধ করতে হয়। মিম্বার ভেঙে গেছে। খুতবা আগে মিম্বারে দাঁড়িয়ে পড়তেন, এখন মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়েন। অথচ রসুলে করিম মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা পাঠ করতেন। মুসুন্ত্রিদের অজুর ব্যবস্থা নাই। মসজিদের পাশে ডোবার মতো আছে, ডোবায় পাট পচানো হয়, সেখানে অজু করা সম্ভব না। সবচে’ ভালো হতো একটা চাপকলের ব্যবস্থা করলে। কে ব্যবস্থা করবে? মাওলানা ইদরিস দশআনির জমিদার নেয়ামত হোসের কাছে গিয়েছিলেন। নেয়ামত হোসেন রাগী গলায় বললেন, মসজিদ করে দিয়েছি, বাকি দেখভাল আপনারা করবেন। চাঁদা তুলে করবেন। আমি টাকার গাছ লাগাই নাই। প্রয়োজন হলেই গাছ ঝাড়া দিব। আর টুপটুপাইয়া টাকা পড়বে। চান্দা তুলেন, চান্দা।
চাঁদা দেয়ার কোনো মানুষ নাই— এটা বলার আগেই নেয়ামত হোসেন উঠে পড়লেন। সন্ধ্যার পর তিনি বেশিক্ষণ বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। সম্প্রতি তিনি লখনৌ থেকে পেয়ারীবালা নামের এক বাইজি এনেছেন। সন্ধ্যা থেকে নিশি রাত পর্যন্ত তার সঙ্গে সময় কাটান। এটা নিয়ে কেউ কিছু মনে করে না। জমিদার শ্রেণীর মানুষদের বিলাস ত্রুটির মধ্যে পড়ে না। তারা আমোদ ফুর্তি করবে না তো কে করবে?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, মাওলানা ইদারিস বদনায় রাখা পানি দিয়ে অজু করে আযান দিলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন কেউ আসে কি-না। কেউ এলো না। তিনি মোমবাতি জ্বলিয়ে একই নামাজ পড়লেন। সালাম ফেরাবার সময় বাতাসে মোমবাতি নিভে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তার বুক ধ্বক করে উঠল। নির্জন মসজিদে জিন নামাজ পড়তে আসে। ইমাম নামাজ পড়াতে ভুল করলে তারা বড় বিরক্ত হয়। চড়থাপ্পড় মারে।