বাবা! আমি যাই?
হরিচরণ চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তাঁর মনে ভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল। শিউলি কথা বলছে।
দাঁড়িয়ে আছে জুলেখা। তার মুখ হাসি হাসি। সে হারিকেন খুঁজে পেয়েছে। তিনটা ঘরে হারিকেন জ্বলছে। শুধু বারান্দায় আলো দেয়া হয় নি। হরিচরণ বললেন, গান কোথায় শিখেছি মা?
জুলেখা লজ্জিত গলায় বলল, বাপজানের কাছে। আমার ব্যাপজান বাউল। উনি মালজোড়া গান করেন।
মালজোড়া গান কী?
প্ৰশ্ন-উত্তর। এক বাউল প্রশ্ন করে আরেকজন উত্তর দেয়। মালজোড়া গানে আমার ব্যাপজানের সাথে কেউ পারত না।
উনি কি মারা গেছেন?
জে না। বাড়ি থাইকা পালায়া কোথায় জানি গেছে, আর আসে নাই। দশ বছর হইছে। মনে হয়। বিয়াশাদি কইরা নয়া সংসার পাতছে।
জুলেখা খিলখিল করে হাসছে যেন বাবার নতুন সংসার পাতা আনন্দময় কোনো ঘটনা।
হরিচরণ বললেন, মাগো! তোমার কণ্ঠস্বর অতি মনোহর। একদিন এসে আমারে গান শুনাবে।
জুলেখা নিচু হয়ে হরিচরণকে কদমবুসি করল।
সময় ১৯০৫। তখন ময়মনসিংহ জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খাজা সলিমুল্লাহ (ঢাকার নবাব)। ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসনের অধীন। ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন লর্ড কার্জন। তিনি বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ অনুযায়ী আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী নিয়ে হবে পূর্ববঙ্গ। ঢাকা হবে রাজধানী, চট্টগ্রাম বিকল্প রাজধানী। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজ ফুঁসে উঠে। বাংলা ভাগ করা যাবে না।
ঢাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে- এটিও হিন্দুসমাজ নিতে পারছিল না। পূর্ব বাংলা চাষার দেশ, তারা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী করবে?
হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তখন বাড়ছে। সেই বিরোধ মেটাবার জন্যে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। সেই অনেকের মধ্যে একজন হলেন ঠাকুরবাড়ির এক কবি, নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান করলেন। সবাই সবার হাতে রাখি বেঁধে দেবে। কারো মধ্যে কোনো হিংসা-দ্বেষ থাকবে না।
রাশিয়ায় তখন জারতন্ত্র। শেষ জার নিকোলাই আছেন ক্ষমতায়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। লেনিন জার্মানিতে। তিনি তখনো রাশিয়ায় পৌঁছেন নি। ম্যাক্সিম গোর্কি নামের এক মহান লেখক একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছেন। উপন্যাসের নাম “মা”।
সেইসময়ে ইউরোপের অবস্থাটা একটু দেখি। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বাইশ বছর বয়সি এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি পদার্থবিদ্যার উপর তিন পাতার এক প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছেন— Annals of Physics-এ। আলো সম্পর্কে তার নিজের চিন্তাধারা প্ৰবন্ধটিতে বলা হয়েছে। প্ৰবন্ধটি পড়ার পর জার্নালের সম্পাদক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কস প্ল্যাংক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারছেন পদার্থবিদ্যার এতদিনকার সব চিন্তাভাবনার অবসান হতে যাচ্ছে। আসছে নতুন চিন্তা। শুদ্ধতম চিন্তা। বাইশ বছর বয়সি পেটেন্ট ক্লার্কের নাম আলবার্ট আইনষ্টাইন।
গ্রামের নাম বান্ধবপুর
গ্রামের নাম বান্ধবপুর। পাশের গ্রাম সোনাদিয়া। উত্তরে গারো পাহাড়। পরিষ্কার কুয়াশামুক্ত দিনে উত্তরের দিগন্তরেখায় নীল গারো পাহাড় ঝলমল করে। দুগ্রামের মাঝখানে মাধ্যই খাল। এই খাল বর্ষাকালে ফুলে ফোঁপে নদী। মাধ্যই খাল সোহাগগঞ্জ বাজারে এসে পড়েছে বড়গাঙে। বড়গাঙের অবস্থা বর্ষাকালে ভয়াবহ। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। এমন। লঞ্চ-স্টিমার যাতায়াত করে। সোহাগগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ হয়ে কোলকাতা।
বান্ধবপুর অতি জঙ্গলা জায়গা। প্রতিটি বসতবাড়িব চারপাশে ঘন বন। এমন ঘন যে দিনমানে সূর্যের আলো ঢেকে না। শিয়াল বাঘডাশারা মনের আনন্দে ঘোরে। মুরগি চুরিতে এরা বিরাট ওস্তাদ। হঠাৎ হঠাৎ বাঘ দেখা যায়। স্থানীয় ভাষায় এইসব বাঘের নাম ‘আসামি বাঘ’। এরা বর্ষার পানির তোড়ে আসামের জঙ্গল থেকে নেমে এসে জঙ্গলে স্থায়ী হয়। গৃহস্থের গরু-ছাগল খেয়ে ফেলে।
আসামি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেলে নিস্তরঙ্গ বান্ধবপুরে হৈচৈ শুরু হয়। সোনাদিয়া জমিদার বাড়িতে খবর চলে যায়। জমিদার বাবু শশাংক পাল হাতির পিঠে চড়ে মাধাই খাল পার হয়ে বান্ধবপুর উপস্থিত হন। তার হাতে দোনলা উইনস্টন বন্দুক। বাঘমারার অনেক কায়দাকানুন করা হয়। জঙ্গল ঘেরাও দেয়া হয়। ঢাকঢোল বাজানো হয়। বাবু শশাংক পাল হাতির পিঠে থেকেই আকাশের দিকে কয়েকবার ফাঁকা গুলি করেন। বাঘ মারা পড়ে না। অন্য কোনো জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। শশাংক পাল হাতির পিঠে করে ফিরে যান। তাকে বড়ই আনন্দিত মনে হয়।
বান্ধবপুর পুরোপুরি হিন্দু গ্রাম। সন্ধ্যায় পুরো অঞ্চলে একসঙ্গে উলুধ্বনি উঠে। শাঁখ বাজানো হয়। প্রতিটি সম্পন্ন বাড়িতে নিত্যপূজা হয়। দুটা কালীমন্দির আছে। একটার নাম বটকালি মন্দির। গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে বটগাছের সঙ্গে লাগানো। বিশাল বটবৃক্ষ এক মন্দিরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে গাছটাকেও মন্দিরের অংশ মনে হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে আয়োজন করে বটকালি মন্দিরে কালীপূজা হয়। পূজার শেষে পাঠা বলি।
বান্ধবপুরে অল্প কয়েকঘর মাত্র মুসলমান। এদের জমিজমা নেই বললেই হয়। বাবুদের বাড়িতে জন খাটে। অনেকেই বাজারে কুলির কাজ করে। কেউ কেউ ঘোড়ার পিঠে মালামাল আনা-নেয়া করে। জুম্মাবারে মাথায় টুপি পরে জুম্মাঘরে উপস্থিত হয়। দোয়াকালাম এরা কিছুই জানে না। জানার আগ্রহ বা উপায়ও নেই। তবে শুক্রবারে গম্ভীর মুখে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টা তাদের মাথায় ঢুকে আছে। তারা মাওলানা সাহেবের খুতবা পাঠ অতি আগ্রহের সঙ্গে শোনে। নামাজ শেষে শিন্নির ব্যবস্থা থাকলে অতি আদবের সঙ্গে কলাপাতায় শিন্নি নেয়। বিসমিল্লাহ বলে মুখে দেয়।