ন্যায়রত্ন বললেন, ধর্ম যুক্তিতে চলে না। ধর্ম চলে বিশ্বাসে। ধর্মের সপ্ত বাহনের এক বাহন বিশ্বাস।
শশাংক পাল বললেন, এইটাও ভালো যুক্তি।
ন্যায়রত্ন বললেন, ধর্ম থেকে যে পতিত তার স্থান পাতালের রসাতলে। পাতালের সাত স্তর, যেমন— অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। রসাতল হলো পাতালের ষষ্ঠ তল। এই তলে যে পতিত, তার গতি নাই।
হরিচরণ বললেন, পাতালের সপ্তম তলে কার স্থান?
মাতৃহন্তার স্থান। যাই হোক, তোমার সঙ্গে শাস্ত্ৰ আলোচনায় আমি যাব না। আমার বিধান আমি দিলাম। তুমি ধন্যবান ব্যক্তি। প্রয়োজনে কাশি থেকে নতুন বিধান নিয়া আসতে পার।
হরিচরণ বললেন, আমি কোনো বিধান আনিব না। আপনার বিধান শিরোধার্য।
শশাংক পাল ইকোয় লম্বা টান দিয়ে বললেন, যাগযজ্ঞ করে কিছু করা যায় না? সপ্তাহব্যাপী যাগযজ্ঞ, নাম সংকীর্তন। হরিচরণ বিত্তবান। সে পারবে।
ন্যায়রত্ন কঠিন গলায় বললেন, না। এই বিষয়ে বাক্যালাপে সময় নষ্ট করা অর্থহীন।
শশাংক পাল বললেন, এটাও ঠিক কথা। তুচ্ছ বিষয়ে সময় হরণ।
হরিচরণ জাতিচ্যুত হলেন সকালে। দুপুরের মধ্যে তাঁর ঘর জনশূন্য হয়ে গেল। মুকন্দ চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় হলো। তাকে তিনি দুটো দুধের গাই দিয়ে দিলেন। রান্নাবান্নার জন্যে যে মৈথিলি ঠাকুর ছিল, সে চুলা ভেঙে চলে গেল। নিয়ম রক্ষা করল। পতিতজনের ঘরের চুলা ভেঙে দেয়া নিয়ম। যেকোনো একটা ঘরের চালাও তুলে ফেলতে হয়। আত্মীয়স্বজনরা সেই চালা মাড়িয়ে চলে যাবে। হরিচরণের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই বলে চালা ভাঙা হলো না।
বৃদ্ধা মায়ালতাকে সন্ধ্যার মধ্যে তিনি নৌকায় কাশি পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। মায়ালতা সঙ্গে করে কষ্টিপাথরের রাধাকৃষ্ণ মূর্তি নিয়ে গেলেন। বিদায়ের সময় হরিচরণ জেঠিমা’কে শেষ প্ৰণাম করতে গেলেন। মায়ালতা আঁৎকে উঠে বললেন, খবরদার পায়ে হাত দিবি না। তুই ড়ুবছস, আমারে ড়ুবাইস না। মায়ালতার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হরিচরণের বিশাল বাড়ি হঠাৎ খালি হয়ে গেল।
সন্ধ্যা মিলাতে না মিলাতেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস। হরিচরণ পাকা দালানের একপাশে বেতের ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বৃষ্টি দেখছেন। তামাক খেতে ইচ্ছা করছে, তামাক সাজাবার কেউ নেই। তামাক নিজেকেই সাজাতে হবে। ঘর অন্ধকার। সন্ধ্যার বাতি জ্বালানো প্রয়োজন। কোথায় হারিকেন কোথায় কেরোসিন তিনি কিছুই জানেন না।
বাড়ির পেছনে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। ভূত-প্ৰেত কি-না কে বলবে! ভূতপ্ৰেতরা শূন্যবাড়ির দখল নিয়ে নেয়— এমন জনশ্রুতি আছে। হাসনাহেনার ঝোপের কাছে সরসর শব্দ হচ্ছে। সাপ বের হয়েছে না-কি? শূন্যবাড়িতে ভূত প্রেতের সঙ্গে সাপও ঢোকে। বাড়ি পুরোপুরি জনশূন্য হলে আসে বাদুড়। তারা মহানন্দে বাড়ির কড়ি বর্গ ধরে মাথা ঝুলিয়ে দুলতে থাকে। যে বাড়িতে সাপ ও বাদুর সহবাস করে সেই বাড়ির মেঝে ফুড়ে অশ্বখ গাছের চারা বের হয়। বাড়িও তখন হয়। পতিত।
মানুষের যেমন প্ৰাণ আছে, বসতবাড়িরও আছে। পতিতবাড়ি হলো প্রাণশূন্য বাড়ি।
ঢং করে কাসার পাত্র রাখার শব্দ হলো। হরিচরণ চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ মেলে চমৎকৃত হলেন। জহিরের মা ঘোমটা দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতেই। বৃষ্টিতে ভিজে মনে হয় মজা পাচ্ছে। জুলেখা কাসার থালাভর্তি করে খাবার এনেছে। চিড়া, নারিকেল কোড়া, এক গ্লাস দুধ এবং দুটা কলা। হরিচরণ বললেন, মাগো আজি আমি কিছু খাব না। উপাস দিব।
জুলেখা স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি না খেলে আমিও খাব না। আমি এইখানে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ায়ে থাকব।
হরিচরণ হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাস নিলেন।
জুলেখা বলল, ঘর অন্ধকার। বাতি দিতে হবে। হারিকেন কোন ঘরে?
হরিচরণ বললেন, কিছুই তো জানি না।
আপনার সঙ্গে কি কেউ নাই?
না।
আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার সব কাজকর্ম কইরা দিব।
প্রয়োজন নাই। তুমি মেয়েমানুষ— এখানে যদি আসো, লোকে নানান কথা বলবে।
আপনি আমারে মা ডেকেছেন। মা ছেলের কাছে আসবে, এতে দোষ নাই।
তোমার ছেলে কোথায়?
ছেলে বাপের সাথে বিরামদি। হাটে গেছে। রবারের জুতা কিনবে।
জুলেখা অন্ধকার ঘরে হারিকেন খুঁজছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘর যাচ্ছে। এমনভাবে যাচ্ছে যেন এটা তার নিজের বাড়িঘর। মেয়েটা আবার গুনগুন করে গানও করছে–
কে বা রান্ধে
কে বা বাড়ে
কে বা বসে খায়।
কাহার সঙ্গে শুইয়া থাকলে
কে বা নিদ্ৰা যায়?
মনায় রান্ধে
তনায় বাড়ে
আতস বসে খায়
সাধুর সঙ্গে শুইয়া থাকলে
সুখে নিদ্ৰা যায়।
কী মিষ্টি মেয়েটার গলা! যেন সোনালি বর্ণের কাঁচা মধু ঝরে ঝরে পড়ছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। শত শত জোনাকি বের হয়েছে। ঝাঁক বেঁধে উড়ছে। শিউলি গাছ জোনাকিতে ঢেকে গেছে। তারা একসঙ্গে জুলছে, একসঙ্গে নিভছে। কী মধুর দৃশ্য! হরিচরণের হঠাৎ তার মেয়ের কথা মনে পড়ল। মেয়েটা বেঁচে থাকলে কত বড় হতো? সে দেখতে কেমন হতো? চেহারা মনে পড়ছে না। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল ছিল এটা মনে পড়ছে। কোঁকড়া চুল অলক্ষণ। কারণ দেবী অলক্ষীর মাথায় চুল ছিল কোঁকড়া। তিনি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে অনেকবার বলেছেন- শৈশবের কোঁকড়া চুল বয়সকালে থাকে না। মেয়েটা জীবিত থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যেত। বাবার দুঃসংবাদ শুনে সে কি ছুটে আসত? না-কি তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আটকে দিত? শাস্ত্র বিধান কী বলে? পতিত পিতার সন্তানরাও কি পতিত?