মুকুন্দ বলল, বেঁচে আছে।
ছেলেটার নাম কী?
জহির।
জহির তাহলে বেঁচে গেছে?
জে আজ্ঞে।
হরিচরণ বললেন, ঠাকুরঘরের তালা খোল। ঘরে বাতি দাও। ঠাকুরঘরে যাব।
মুকুন্দ বিনীতভাবে বলল, সকালে যান। এখন শুয়ে থাকেন। আপনার শরীর অত্যধিক খারাপ।
ঠাকুরঘরের তালা খোল।
গভীর রাতে ঠাকুরঘরের দরজা খোলা হলো। প্ৰদীপ জ্বালানো হলো। ছোট্ট ঘর। শ্বেতপাথরের জলচৌকিতে কষ্টিপাথরের রাধা-কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বাঁশি ধরে আছেন। তাঁর কাধে মাথা রেখে লীলাময় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন শ্ৰী রাধিকা।
হরিচরণ পদ্মাসন হয়ে বসলেন। মুকুন্দকে বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে আস, আমি একটু দেখব।
ঠাকুরঘরে নিয়ে আসব? কী বলেন এইসব!
হ্যাঁ, ঠাকুরঘরে নিয়ে আসা। সে আমার কোলে বসবে।
মুসলমান ছেলে তো!
হোক মুসলমান ছেলে।
জহিরের মা জহিরকে কোলে নিয়ে এসেছে। সে তার সবুজ শাড়ি দিয়ে ছেলেকে ঢেকে রেখেছে। তার চোখে উদ্বেগ। বাড়িতে এত লোকজন দেখে হ’কচাকিয়ে গেছে। হরিচরণ উঠানের জলচৌকিতে বসেছেন। তাঁর নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। শরীর ঘামিছে। তিনি জহিরের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো! আপনার ছেলে কি ভালো আছে?
জহিরের মা জবাব না দিয়ে ছেলেকে আরো ভালো করে শাড়ি দিয়ে ঢাকল। হরিচরণ বললেন, আমার এখানে ডাক্তার আছে। ছেলেকে দেন, ডাক্তার দেখুক।
আমার ছেলে ভালো আছে।
হরিচরণ মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনেও মুগ্ধ হলেন। কী সুরেলা কণ্ঠ! ঈশ্বর যার প্রতি করুণা করেন। সর্ব বিষয়েই করেন। মেয়েটি খালি পায়ে উঠানে দাড়িয়ে আছে। হরিচরণের মনে হলো, মেয়েটির পায়ের কারণেই উঠান ঝলমল করছে। এত রূপবতী কেউ কি এর আগে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে?
মাগো! আপনার ছেলেকে আমার কোলে দেন। আপনার ছেলে কোলে নিয়ে আমি একটা প্রার্থনা করব।
হরিচরণ ঠাকুরঘরে বসে আছেন। তাঁর কোলে জহির। জহির ঘুমাচ্ছে। শান্তির ঘুম। হরিচরণ হাতজোড় করে বললেন, হে পরম পিতা। হে দয়াময়। আজ রাতে আমি তোমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করতে চাই। আমি আমার এক জীবনে যা উপার্জন করেছি, সবই জনহিতকর কার্যে দান করব। আমি যেন আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি এইটুকু শুধু তুমি দেখবে। আমি পৃথিবীতে নগ্ন অবস্থায় এসেছিলাম, পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বিদায় নিব।
হরিচরণের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
পরদিন সকালেই একটি মুসলমান ছেলেকে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করানোর অপরাধে হরিচরণকে সমাজচ্যুত করা হলো। সোনাদিয়ার জমিদার শশাংক পালের বৈঠকখানায় সমাজপতিদের বৈঠক বসল। বৈঠকের প্রধান বক্তা ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায়। তিনি শাস্ত্ৰ ভালো জানেন। তাঁকে আনা হয়েছে শ্যামগঞ্জ থেকে। শশাংক পাল ঘোড়া পাঠিয়ে আনিয়েছেন। ধর্মবিষয়ক অনাচার তিনি নিতেই পারেন না। ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায় কঠিন কঠিন কথা বললেন। মহাভারতের কিছু কাহিনীও বললেন যার সঙ্গে হরিচরণের সমস্যার কোনো সম্পর্কই নেই। সুশোভনার গর্ভে পরিক্ষীতের তিন পুত্ৰ— শল, দল এবং বলের গল্প। শল রাজা হয়েছেন, তিনি ব্ৰাহ্মণ বামদেবের কাছ থেকে দুই ঘোড়া ধার হিসেবে নিয়ে এসেছেন। হরিণ শিকারের জন্যে। হরিণ শিকার হলো কিন্তু রাজা শল দুই ঘোড়া ফেরত পাঠালেন না। বামদেব যখন ঘোড়া ফেরত চাইলেন, তখন রাজা শল বললেন, আপনার ঘোড়ার প্রয়োজন কী? বেদই তো আপনার বাহন।
গল্প শেষ করে ন্যায়রত্ন কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে চোখ খুলে বললেন, হরিচরণের সর্বনিম্ন শাস্তি সমাজচ্যুতি।
অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য ক্ষীণস্বরে প্রায়শ্চিত্যের কথা বলে ধমক খেলেন।
ন্যায়রত্ব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি পূজারি বামুন শাস্ত্ৰ জানো না বলে প্ৰায়শ্চিত্যের কথা বললা। ঠাকুরঘর যে অপবিত্র করেছে তার আবার প্রায়শ্চিত্য কী?
অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, ঠিক ঠিক। এই বিষয়টা মাথায় ছিল না।
ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন,
কালী করালী চ মনোজবা চ
সুলোহিতা যা চ সুব্ধূমাবর্ণ।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চি দেবী
লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহবাঃ।
অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য আবারো বললেন, ঠিক ঠিক।
ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন, ব্যাখ্যা করব?
অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, আমি প্রয়োজন দেখি না। বিধান শুধু বলে দেন।
ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন, বিধান আগে একবার বলেছি। আরেকবার বলি। বিধান হলো, হরিচরণ সমাজচ্যুত। হরিচরণের সঙ্গে যারা বাস করে তারাও সমাজচ্যুত। তবে তাদের জন্যে প্ৰায়শ্চিত্যের সুযোগ আছে। তারা টাটকা গোবর ভক্ষণ করে এবং সাধ্যমতো দান করে শুদ্ধ হতে পারে। অন্যথায় তাদের সবার জন্য ধোপা-নাপিত বন্ধ। সামাজিক আচার বন্ধ।
হরিচরণ হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন। হরিচরণের পেছনে হাতজোড় করে মুকন্দি দাঁড়িয়ে আছে। সে সামান্য কাঁপছে। তার চোখ ভেজা। মুকন্দের শব্দ করে কাদার ইচ্ছা। সে ভয়ে কাঁদতে পারছে না। ন্যায়রত্ন বললেন, হরিচরণ, তুমি কিছু বলতে চাও?
হরিচরণ না-সূচক মাথা নাড়লেন।
অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, হরিচরণের ঘরে রাধা-কৃষ্ণ আছে। ঠাকুর পূজা হয়। এর কী বিধান?
ন্যায়রত্ন বললেন, মূর্তি সরিয়ে নিতে হবে। গাভী যদি থাকে গাভী নিয়ে নিতে হবে। সে গাভী সেবা করতে পারবে না।
হরিচরণ বললেন, অন্য জাতের মানুষও গাভী পালন করে। আমার জাত গিয়েছে, আমি গাভী পালন করতে পারব না কেন?
শশাংক পাল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ভালো যুক্তি। অতি উত্তম যুক্তি।