কী নাম তোমার?
ছেলে জবাব দিল না।
নাম বলবে না?
সে না-সূচক মাথা নাড়ল।
কী খাচ্ছ?
ছেলে হা করে তার মুখ দেখাল। মুখের ভেতর জামের লাল একটা বিচি। তিনি বললেন, সন্দেশ খাবে?
ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তিনি ডাকলেন, মুকুন্দ! মুকুন্দ!
মুকুন্দ আশেপাশে নেই। সে পিপড়ার ডিমের সন্ধানে চলে গেছে। পাকা বাড়িতে বৃদ্ধা মায়ালতা থাকেন। হরিচরণের দূরসম্পর্কের বিধবা জেঠি। তিনি কানে শোনেন না। শুনলেও ঘর থেকে বের হবেন না। রান্নার জন্যে একজন ঠাকুর আছে। সে বাজারে গেছে মাছের সন্ধানে। হরিচরণ বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক। কোথাও যাবে না। আমি সন্দেশ নিয়ে আসছি।
ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হরিচরণের প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে কোলে নিতে। কোলে নেবার জন্যে সময়টা ভালো। আশেপাশে কেউ নেই। কেউ দেখে ফেলবে না। তিনি এক মুসলমান কাঠমিস্ত্রির ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন— এই দৃশ্য হাস্যকর। ধর্মেও নিশ্চয়ই বাধা আছে। যবনপুত্ৰ অস্পৃশ্য হবার কথা। ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য, শূদ্ৰ। শূদ্রের নিচে যবনের অবস্থান।
হরিচরণ সন্দেশ এবং এক গ্রাস পানি হাতে ফিরলেন। ছেলেটা যেখানে দাড়িয়ে থাকার কথা সেখানে নেই। জামতলাতেও নেই। পেয়ারা বাগানেও নেই। দিঘির পানিতে ড়ুবে যায় নি তো? তাঁর বুক ধ্বক করে উঠল। তিনি দিঘির দিকে তাকালেন। দিঘির জল শান্ত। সবুজ শ্যাওলার যে চাদর দিঘি। জুড়ে ছড়িয়ে আছে সে চাদরে কোনো ভাঙচুর নেই।
ছেলেটার নাম জানা থাকলে তাকে নাম ধরে ডাকা যেত। তিনি নাম জানেন না। এই কাজটা ভুল হয়েছে। দুটা পিঁপড়া যখন মুখোমুখি হয় তখন তারা কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে। বেশিরভাগ সময়ই মানুষরা এই কাজ করে না। একজন আরেকজনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তিনি পেয়ারা বাগানের দিকে গেলেন। পেয়ারা বাগানের পরই ঘন বেতবোপ। ছেলেটা বেতঝোপের ওপাশে যায় নি তো?
সেখানেও তাকে পাওয়া গেল না। আকাশের মেঘ ঘন হয়েছে। যে-কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। হরিচরণ ঘাটের কাছে ফিরে গেলেন। তার হাতে সন্দেশ। সন্দেশ থেকে অতি মিষ্টি গন্ধ আসছে। দারুচিনির গন্ধ না-কি? সন্দেশে গরম মসল্লা দেয়া নিষেধ। দেবীর ভোগে সন্দেশ দেয়া হয়। সেই সন্দেশ বিশুদ্ধ হতে হয়। এলাচ দারুচিনি দিয়ে বিশুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না। তাহলে গন্ধটা কিসের? দুধের গন্ধ? ঘন দুধের কি আলাদা গন্ধ আছে?
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আষাঢ় মাসের বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে ভিজিয়ে দেবে। দৌড়ে ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। এই বয়সে বৃষ্টিতে ভেজার ফল শুভ হবে না। তারপরেও তিনি ঘাট ছাড়তে পারলেন না। তার কাছে মনে হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন ছেলেটা ভিজতে ভিজতে আসছে।
মুকুন্দ কলাপাতার ঠোঙ্গায় পিপড়ার ডিম নিয়ে এসেছে। সে অবাক হয়ে বলল, বিষ্টিত ভিজেন? অসুখ বাধাইবেন। ঘরে যান।
হরিচরণ বললেন, যাব একটু পরে। তুমি সন্দেশ দুটা ঐ ছেলেটারে দিয়া আসি।
কোন ছেলে?
কাঠমিস্ত্রির ছেলে। আজ আর বর্শি নিয়ে বসব না।
মুকুন্দ অনিচ্ছার সঙ্গে যাচ্ছে। ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। তার এক হাতে পিপড়ার ডিম অন্য হাতে সন্দেশ। মাছ ও মানুষের খাদ্য। হরিচরণ হঠাৎ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন, ডিমগুলির জন্যে তার খারাপ লাগছে। এই ডিম থেকে আর কোনোদিন পিঁপড়ার জন্ম হবে না। তারা পৃথিবীর অতি আশ্চর্য রূপ-রস-গন্ধের কিছুই জানবে না। বড়ই আফসোসের কথা। তিনি কি মুকুন্দকে বলবেন ডিমগুলি যেখান থেকে এনেছে সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে? হয়তো এখনো সময় আছে। জায়গামতো পৌঁছে দিলে কিছু ডিম থেকে পিঁপড়া জন্মাবে।
মুকুন্দ অনেকদূর চলে গেছে, এখন ডাকলে সে শুনতে পাবে না। তবু তিনি ডাকলেন, মুকুন্দ! মুকুন্দ!
মুকুন্দ শুনতে পেল না। কিন্তু কেউ একজন হাসল। হরিচরণ চমকে হাসির শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকালেন। কী আশ্চর্য, লাল প্যান্ট পরা ছেলেটা। সে দিঘির অন্যপ্রান্তে। পাড় বেয়ে পানির দিকে নামছে। বৃষ্টির পানিতে দিঘির পাড় পিচ্ছিল হয়ে আছে। ছেলেটা কি একটা দুর্ঘটনা ঘটাবে? পা পিছলে। পানিতে পড়ে যাবে? তিনি ডাকলেন, এই, এই— উঠে আস। উঠে আস বললাম। এই ছেলে, এই!
ছেলেটা তাঁকে দেখল। কিন্তু তার দৃষ্টি দিঘির সবুজ পানিতে। তার হাতে কাদামাখা পেয়ারা। সে পেয়ারা পানিতে ধুবে। তিনি উঁচু গলায় আবারো ডাকলেন, এই ছেলে- এই। তখনি ঝাঁপ করে শব্দ হলো। কিছুক্ষণ ছেলেটির হাত পানির উপর দেখা গেল। তারপরেই সেই হাত তলিয়ে গেল। হরিচরণ পুকুরে ঝাঁপ দিলেন।
হরিচরণ কীভাবে দিঘির অন্যপ্রান্তে পৌঁছলেন, কীভাবে ছেলেটাকে পানি থেকে তুললেন তা তিনি জানেন না। শুধু এইটুকু জানেন- পানি থেকে তোলার পর দেখা গেল, ছেলেটার ডানহাত অনেকখানি কেটেছে। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। স্বপ্নে শ্ৰীকৃষ্ণের হাত কেটে এইভাবেই রক্ত পড়ছিল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ও বাবু! বেঁচে আছিস তো! বলেই পুকুরপাড়ে জ্ঞান হারালেন।
তাঁর জ্ঞান ফিরল নিজের খাটে গভীর রাতে। তাঁর চারপাশে মানুষজন ভিড় করেছে। নেত্রকোনা সদর থেকে এলএমএফ ডাক্তার সতীশ বাবু এসেছেন। তিনি বুকে স্টেথিসকোপ ধরে আছেন। পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধা মায়ালতার কান্না শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ কারণে অকারণে কঁদে। হরিচরণ বললেন, ছেলেটা কি বেঁচে আছে?