তখনকার ব্যবস্থায় রঙিলা বাড়ি এমন কিছু খারাপ জায়গা না। পুরুষ মানুষদের আমোদ-ফুর্তির অধিকার আছে। তারা খাটাখাটনি করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থের খানিকটা যদি নিজের আনন্দের জন্যে ব্যয় করে, তাতে ক্ষতি কী? পুরুষ মানুষ দিনরাত স্ত্রীর আঁচলে বাধা থাকলে ধরতে হবে সে পুরুষ মানুষই না। তার কোনো সমস্যা আছে। ক্ষমতাবান পুরুষদের হতে হবে শৌখিনদার। তারা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করবে। রঙিলা বাড়িতে যাবে। কিছুদিনের জন্যে বাড়িতে ঘাটুগানের ছেলে নিয়ে আসবে। ঘাটুগানের এইসব ছেলে নৃত্যবিদ্যা এবং সঙ্গীতে পারদশী। শৌখিনদার পুরুষের নানান আবদার (!) এরা মিটাবে। এইসব কর্মকাণ্ডে স্ত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার কিছু নাই। ঘাটুছেলেরা তাদের সতিন না। এরা কিছুদিনের জন্যে এসেছে। সতিনের মতো চিরস্থায়ী সত্ত্ব নিয়ে আসে নি।
বান্ধবপুর সেই সময় অতি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। রমরমা পাটের ব্যবসা। লবণের ব্যবসা। মাছের ব্যবসা। নতুন লঞ্চঘাট হয়েছে। দিনরাত লঞ্চের ভোঁ শোনা যায়। বরফকল বসেছে। প্যাটরায় বরফ ভর্তি হয়ে দৈত্যকৃতির মাছ চলে যায় নারায়ণগঞ্জ, কোলকাতায়। জলমহাল নিয়ে মারামারি খুনখুনি হয়। সাহেব পুলিশ অফিসার হাতিতে করে তদন্তে আসেন। তদন্ত শেষে পাখি শিকার করেন। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে রঙিলা উৎসব হয়। নর্তকীরা নাচ-গান করে। ঘাটছেলেরা বুকে নারিকেলের মালা বেঁধে ঠোঁটে রঙ দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গিমায় অতি নোংরা গান ধরে। সাহেবরা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলেন, Not bad, Not bad at all.
এই বিপুল কর্মকাণ্ডে আমাদের জুলেখা অতি নগণ্য একজন। আপাতত তার কথা থাকুক। আমরা চলে যাই হরিচরণের স্কুলে। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা নয়। নয়জনের মধ্যে একজন মাত্র মুসলমান। তার নাম জহির। এই ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হবে। অতিরিক্ত ভালো। স্মরণশক্তি অসাধারণ। একবার কিছু পড়লেই তার মনে থাকে। শশী মাস্টার তার এই ছাত্রটিকে কোনো এক বিচিত্র কারণে সহ্য করতে পারেন না।
ব্রিটিশ সরকার সে সময়ে একটি বৃত্তি চালু করেছিলেন। সমগ্ৰ ভারতে ক্লাস টুর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এই বৃত্তি দেয়া হতো। মাসিক দুটাকা হারে এক বৎসরের জন্যে বৃত্তি। সুলেমানের ছেলে জহির এই বৃত্তি পেয়ে সবাইকে চমকে দিল। জেলা শিক্ষা অফিসার আলহাজ রমিজউদ্দিন সাহেব বৃত্তির খবর নিয়ে বান্ধবপুরে উপস্থিত হলেন। জহিরের মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া করলেন। তারপর জহিরকে কাছে টেনে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার মা নাকি তোমাদের সঙ্গে থাকে না। এটা কি সত্য?
জহির বলল, সত্য।
সে থাকে কোথায়?
জহির চুপ করে রইল। জবাব দিল না।
কোথায় থাকে জানো না?
জহির এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। আলহাজ রমিজউদ্দিন গলা আরো খাদে নামিয়ে বললেন, লোকমুখে শুনলাম তোমার মা রঙিলা নটিবাড়িতে থাকে, এটা কি সত্য?
সত্য।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। যা হয় সবই আল্লাহ পাকের হুকুমেই হয়। উনার হুকুম বিনা কিছু হয় না। তুমি নিজের মতো লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। তোমার মা কোথায় থাকে কী সমাচার তা নিয়া মাথা ঘামাবে না। ঠিক আছে?
হুঁ।
ছি না, বলো জি আচ্ছা, জনাব। এইসব সাহি আদব। শুধু লেখাপড়া শিখলে হবে না। আদবও শিখতে হবে। বিলো, জি আচ্ছা, জনাব।
জি আচ্ছা, জনাব।
আলহাজ্বরমিজউদ্দিন জহিরকে একটা ফাউন্টেনপেন উপহার হিসেবে দিয়ে গেলেন। ফাউন্টেনপেনের নাম রাইটার।
শশী মাস্টারের কাছে জুলেখার শীতলপাটি পৌঁছেছে। যে নিয়ে এসেছে তার নাম সামছু সদাগর। মিশাখালি বাজারে তার পাটের আড়ত। শশী মাস্টার বললেন, পাটি কে দিয়েছে?
সামছু সদাগর বললেন, রঙিলা নটিবাড়ির এক নটি দিয়েছে। রাখলে রাখেন, না রাখলে ফেলে দেন। নটির নাম চান বিবি।
চান বিবি নামে কাউকে আমি চিনি না।
আপনি মাস্টার মানুষ। আপনার না চেনাই ভালো। তার আরেক নাম জুলেখা।
জুলেখা? সামছু সদাগর বললেন, এখন কি চিনেছেন?
হ্যাঁ চিনেছি।
পরিচয় ছিল আপনার সাথে?
ছিল।
চাইপা যান। কাউরে কবেন না। মাস্টার সাব, উঠি?
শশী মাস্টার সারা দুপুর ঝিম ধরে বসে রইলেন। সন্ধ্যার পর কলের গান ছেড়ে জামগাছের নিচে গভীর রাত পর্যন্ত বসে রইলেন।
মাওলানা ইদরিসের কাছে জুলেখার পাঠানো তুর্কি টুপি পৌঁছেছে। সামছু সদাগরই নিয়ে গেছে।
মাওলানা বললেন, আপনারে তো চিনলাম না।
সামছু সদাগর বললেন, আমারে চেনার প্রয়োজন নাই। আপনার কাছে একটা জিনিস পৌঁছায়ে দেওয়ার কথা। দিলাম।
জিনিসটা দিয়েছে কে?
চান বিবি দিয়েছে।
চান বিবিকে তো চিনি না!
সামছু সদাগর উদাস গলায় বললেন, এখন তারে না চেনাই ভালো। সময়ে চেনা সময়ে না-চেনা বুদ্ধিমান মানুষের লক্ষণ। আপনি বুদ্ধিমান।
মাওলানা ইদরিস বললেন, একজন এত সুন্দর একটা টুপি পাঠায়েছে, তারে চিনিব না- এটা কেমন কথা?
সামছু বলল, চিনতে হইলে রঙিলা নটি বাড়িতে যান। ঐ মেয়ে রঙিলা বাড়ির নটি।
মাওলানা হতভম্ব গলায় বললেন, এইটা কী কথা?
সত্য কথা। নটি বেটি আপনারে টুপি পাঠায়েছে। বড়ই সৌন্দর্য মেয়ে। বেহেশতের হুর বরাবর সুন্দর। তার টুপি আপনি মাথায় দিয়ে জুম্মার নামাজ। না গাঙের পানিতে ফেলবেন— এটা আপনার বিবেচনা। আমি উঠলাম।
তুর্কি ফেজ টুপিটা টিনের ট্রাঙ্কের উপর রাখা। টুপিটা কোথেকে এসেছে মাওলানা এখন বুঝতে পারছেন। এই টুপি মাথায় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। গাঙের পানিতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। টুপির মতো পবিত্র একটি বস্তু পানিতে ফেলে দেওয়া কি ঠিক? এই বিষয়ে হাদিস কোরানের পরিষ্কার ব্যাখ্যা কী তাও তিনি জানেন না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন তাও সম্ভব হচ্ছে না। হাদিস কোরান জানা লোক আশেপাশে কেউ নেই। তাঁর খুবই ইচ্ছা দেওবন্দ মাদ্রাসায় যাওয়া। তার মনে অনেক প্রশ্ন আছে। তিনি হাতির ছবি আঁকা একটা দু’নম্বরি খাতায় প্রশ্নগুলি লিখে রেখেছেন। যেমন, রোজার সময় ধূমপান করলে কি রোজা ভাঙে? চিংড়ি মাছ খাওয়া মাকরুহ। কাকড়া খাওয়াও কি মাকরুহ? মাওলানা টুপি বিষয়ক একটি প্রশ্ন খাতায় লিখলেন–