ড্যান্স মাস্টার তোমাকে নাচ শেখাবে। শরীরের ভেতরে যদি নাচ থাকে। তাহলে নাচ শিখতে পারবে। যদি না থাকে, তাহলে শিখতে পারবে না। তারপরেও ড্যান্স মাষ্টার তোমাকে নাচ শেখাবে। নাচ করলে শরীর ঠিক থাকবে। ঠিকমতো নাচ করলে মন ঠিক থাকে। সেবাদাসীরা মন্দিরে দেবতার সামনে নাচ করে শরীর এবং মন দুটাই ঠিক রাখে।
আমাদের এই বাড়িটাও মন্দির। যেসব পুরুষ এই বাড়িতে আনন্দের খোজে আসে তারা দেবতা।
কখনো নিলাজ হবে না। পুরুষমানুষ। নটি বেটির কাছেও লজ্জা আশা করে। কোনো যক্ষ্মারোগীকে ঘরে নিবে না। যত টাকাই সে দিক তাকে ঘিরে নেয়া যাবে না। যক্ষ্মীরোগী চেনার উপায় আছে। আমি তোমাকে শিখায়ে দেব। তোমার স্বামী, স্বামীর দিকের আত্মীয় কাউকে ঘরে নিবে না। স্বামীকে কোনো অবস্থাতেই না। খদেরদের কারো কারো স্ত্রীরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তাদের সঙ্গে কখনো কোনো অবস্থায় দেখা করবে না। খদের আমাদের দেবতা। খন্দেরের স্ত্রীরা উপদেবতা। উপদেবতারা ভয়ঙ্কর। তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়।
যদি কখনো মনে কর এই জায়গা, এই জীবন তোমার পছন্দ না, তুমি চলে যেতে চাও, তাহলে চলে যাবে। কেউ তোমাকে আটকাবে না। আমি জেলখানা খুলে বসি নাই। দুঃখী মানুষের জন্যে আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করেছি। মানুষকে আনন্দ দেয়ার মধ্যে পুণ্য আছে। তুমি নিজেও আনন্দে থাকার চেষ্টা করবে।
চান বিবি আনন্দে থাকার চেষ্টা ছাড়াই আনন্দে আছে। নতুন জীবনের শুরুতে প্রথম পুরুষটিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভাটি অঞ্চলের বোকাসোকা চেহারার একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। ফর্সা, লম্বা। চোখেমুখে দিশাহারা ভাব। সে খুব ভয়ে ভয়ে বিছানায় পেতে রাখা শীতলপাটিতে বসল। পকেট থেকে ফুলতোলা ময়লা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব ।
চান বিবি ঝকঝকে কাসার গ্রাসে পানি এনে দিল। লোকটা এক চুমুক পানি খেয়েই গ্রাস নামিয়ে রাখতে রাখতে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুবই গরম।
চান বিবি বলল, বাতাস করব?
না, বাতাস লাগবে না।
দরজার আড়ালে হাছুন উকিঝুকি দিচ্ছিল। চান বিবি তাকে ইশারা করতেই সে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস শুরু করল। লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার মেয়ে?
চান বিবি বলল, আমার মেয়ে না। তবে মেয়ের মতোই। আমাকে আপনি আপনি বলতেছেন কী কারণে? আমি বয়সে আপনার ছোট।
লোকটি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাই।
চান বিবি বলল, চলে যাবেন? কিছুক্ষণ জিরান। বাতাস খান। শরীর ঠাণ্ড। করেন। মন ঠাণ্ডা করেন। আসেন, গল্প করি।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বসল। আবার পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। তবে এবার রুমালটা পকেটে ঢুকাল না। হাতে নিয়ে বসে রইল। চান বিবি বলল, রুমালে সুন্দর ফুলের কাজ। কে করেছে? আপনার স্ত্রী?
হুঁ।
আপনার ছেলেমেয়ে আছে?
দুই মেয়ে।
তারা দেখতে সুন্দর?
হুঁ।
আপনার স্ত্রীর চেহারা কেমন? সুন্দর?
হুঁ।
আমার চেয়েও সুন্দর?
না
আপনি কি কিছু খাবেন? শরবত বানায়ে দিব?
না।
ঘরে মিষ্টি আছে। মিষ্টি দিব? বেগমগঞ্জের লাড্ডু।
না।
আপনার স্ত্রীর নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন।
তার নাম বলব না।
মেয়ে দুটার নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন।
বড় মেয়ের নাম শরিফা। ছোট মেয়ের নাম তুলা।
তুলা নাম রেখেছেন কেন? জন্মের সময় খুব হালকা ছিল?
হুঁ। সাত মাসে হয়েছে। বাঁচার আশা ছিল না। হালিমা তাকে শিমুল তুলার বস্তায় ভরে বাঁচায়ে রেখেছিল। এখন তুলার স্বাস্থ্য খুবই ভালো। সারাদিন মারামারি করে। কামড় দেয়া শিখেছে। কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দেয়।
আপনার স্ত্রীর নাম হালিমা?
হুঁ।
নাম বলে ফেলেছেন, এখন কি আপনার খারাপ লাগছে?
লোকটা চুপ করে রইল। প্রসঙ্গ পাল্টে জুলেখা বলল, আপনার মেয়ে তুলা আপনাকে কামড়ায়?
অনেকবার। আমার সারা গায়ে তার কামড়ের দাগ। সে শুধু তার মারে কামড়ায় না।
চান বিবি বলল, আপনার মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল। কয়েকবার টোক গিলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কালো কাপড়ের ছোট্ট থলি বের করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, এখানে দশটা রুপার টাকা আছে। টাকার পরিমাণ কি ঠিক আছে?
চান বিবি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লোকটা উঠে দাঁড়াল। চান বিবি বলল, চলে যাবেন?
হুঁ।
বিশ্রাম করেন। রাতটা থাকেন, সকালে যান।
न।
তাহলে আরেকদিন আসেন। সেদিন টাকা ছাড়াই আসেন।
আমি আর আসব না।
আমার উপর কোনো কারণে কি আপনি নারাজ হয়েছেন?
না। তুমি ভালো মেয়ে।
আপনার স্ত্রীর চেয়েও কি ভালো?
লোকটার চেহারা সামান্যক্ষণের জন্যে কঠিন হয়ে গেল। চান বিবি আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কঠিন মুখভঙ্গি সহজ হলো। লোকটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না।
রুপার টাকার থলেটা চান বিবি সরাজুবালার কাছে পাঠিয়ে দিল। এটাই নিয়ম। সরাজুবালা সেখান থেকে নিজের অংশ রেখে ফেরত পাঠাবেন। চান বিবির পুরো টাকাই সরাজুবালা ফেরত পাঠালেন। প্রথম রোজগারে ভাগ বসালেন না। চান বিবি প্রথম রোজগারের টাকায় তার ছেলে জহিরের জন্যে জামা, জুতা কিনল। বান্ধবপুর জুম্মা মসজিদের ইমাম সাহেবের জন্যে একটা তুর্কি ফেজ টুপি কিনল। শশী মাস্টারের জন্যে কিনল নকশি করা সিলেটের শীতলপাটি। জিনিসগুলি হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ কাঁদল।
ভদ্রঘরের একটি মেয়ের স্থান হয়েছে। রঙিলা বাড়িতে— এই ঘটনা বান্ধবপুরে কোনো আলোড়ন তুলল না। অনেক দিন এই বিষয়টা কেউ জানলও না। সুলেমান সবাইকে বলল, স্ত্রীকে সে তালাক দিয়েছে। স্ত্রী চলে গেছে তার বাপ ভাইয়ের কাছে। মুসলমান সমাজে স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং স্ত্রীর বাপ-ভাইয়ের কাছে চলে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এক স্ত্রী চলে যাবে অন্য স্ত্রী আসবে। স্ত্রী একা আসবে না, সঙ্গে দাসী নিয়ে আসবে। স্ত্রীর গর্ভে যেমন সন্তান হবে, দাসীর গর্ভেও হবে। স্ত্রীর গর্ভের সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পাবে। বান্দির গর্ভের সন্তানরা পাবে না। তারা কামলা খাটবে। তাদের বিয়েশাদি হবে তাদের মতোই বান্দি বংশের লোকজনদের সঙ্গে। সহজ হিসাব।