‘দেশান্তরী’ শব্দটা এলাকার মানুষের অতি প্ৰিয়। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই স্বামীরা বলে, দেশান্তরী হবো, আসাম চলে যাব। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে যাবার বাসনার কারণ— আসাম খুব দূরের দেশ না। বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বতের অঞ্চল। সেখানেই আছে কামরূপ কামাক্ষ্যা। জাদুবিদ্যার দেশ। কামরূপ কামাক্ষ্যার অতি রূপবতী নারীরা পুরুষদের বশ করে চিরদিনের জন্যে রেখে দিতে পছন্দ করে। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে গেলে ফেরা হয় না। সেই কারণেই।
জুলেখা রঙিলা নটিবাড়িতে আনন্দে আছে। জায়গাটা তার পছন্দ হয়েছে। অনেক উঁচু, প্রায় টিলার মতো। বর্ষাকালে সোহাগগঞ্জ বাজারের অনেকটা ড়ুবে যায়। রঙিলা বাড়ি শুধু ভেসে থাকে। দূর থেকে দেখা যায় পানির উপর নকশা কাটা কাঠের একটা বাড়ি ভাসছে। বাড়ির চারদিকে টিনের ছোট ছোট ঘরের চাল থেকে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করে। সন্ধ্যাবেলা হারমোনিয়াম এবং সারেঙ্গির শব্দ ভেসে আসে। বড়ই রহস্যময় লাগে। বর্ষাকালে এই রহস্যময় জায়গায় লোকজনকে আসতে হয় নৌকায়। বেশিরভাগ খদের ভাটি অঞ্চলের পয়সাওয়ালা শৌখিনদার। হাওরের মাছ বিক্রির কাঁচা টাকা নিয়ে এরা আসে। কোমরে টাকার থলি বাধা থাকে। একটু নড়াচড়া করলেই ঝন ঝন শব্দ হয়। নটি মেয়েদের কাঁচা রূপার টাকা নজরানা দেয়া দস্তুর। ময়লা কাগুজে নোটে শৌখিনদারি প্রকাশ পায় না। রঙিলা বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা ভিড়ে তখন তারা চারদিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। তাদের বড়ই অস্থির মনে হয়। পরিচিত কেউ দেখে ফেলল। কি-না এই চিন্তাতেই তারা অস্থির।
অতিরিক্ত পয়সাওয়ালা শরিফ আদমিদের মধ্যে অস্থিরতা থাকে না। তারা বজরা নিয়ে আসে। বজরা থেকে নামে না। তাদের সঙ্গে মাহফিল করতে রঙিলা
ব্যাপারে সাবধানি। হিসাব ছাড়া খরচ করে ভাটি অঞ্চলের বেকুবরা। এরা সব টাকা শেষ করে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরে যায়। তখনও তাদের মধ্যে হাসি থাকে। সেই হাসি অন্যরকম। যেন তারা একটা কাজের কাজ করেছে।
জুলেখা রঙিলা বাড়িতে ভর্তি হয়ে নতুন নাম নিয়েছে চান বিবি। নতুন নাম নেয়াই দস্তুর। অতীত পেছনে ফেলে আসতে হবে। যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এও এক ধরনের সংসার। প্রতিরাতে স্বামী বদলের সংসার। এটাই মন্দ কী?
চান বিবি একটা টিনের ঘর পেয়েছে। ঘরটা তার বড়ই পছন্দের। সামনেই বড়গাঙ। ঘরের বারান্দায় বসে থাকলে বড়গাঙ ছাড়িয়ে দৃষ্টি অনেক দূরে চলে যায়। তখন খুব উদাস লাগে। ঘরের সামনেই বিশাল এক কামরাঙা গাছ। এই গাছে সারা বছরই কামরাঙা হয়। ভয়ঙ্কর টক, কাক দেশান্তরী জাতের কামরাঙা (কাক দেশান্তরী : যে টক ফল খেলে কাক দেশান্তরে পালিয়ে যায়)। এই গাছটাও চান বিবির পছন্দ। গাছের নিচে বসলে চিড়ল চিড়ল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে গায়ে পড়ে। এত ভালো লাগে। চান বিবি ঠিক করেছে, তার যদি কিছু টাকা-পয়সা হয় তাহলে সে কামরাঙা গাছের তলাটা নিজ খরচে বঁধিয়ে দেবে। বাধানো ঘাটে শীতলপাটি বিছানো থাকবে। শীতলপাটির উপরে পরিষ্কার ফুলতোলা বালিশ। কখনো সে বালিশে শুয়ে আকাশ দেখবে। আবার কখনো গাছে হেলান দিয়ে অতি দূরের গ্রামের সীমানা দেখবে।
চান বিবির ফুট ফরমাস খাটার জন্যে তাকে সাত-আট বছরের একটা মেয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার নাম হাছুন। চান বিবি হাছুনকে নিজের মেয়ের মতো যত্ন করে। মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয়। সপ্তাহে একদিন জলেভাসা সাবান দিয়ে তার গা ডলে দেয়। হাছুন চান বিবিকে মা ডাকে। সারাদিনই সে ঘর পরিষ্কার করে। সন্ধ্যাবেলা কার্তিকের মূর্তিতে প্ৰদীপ জ্বেলে দেয়। ধূপদানে ধূপ জ্বলে। রঙিলা বাড়ির প্রতিটি ঘরেই কার্তিকের মূর্তি আছে। কাৰ্তিক পতিতাদের দেবতা। পতিতা হিন্দু হোক মুসলমান হোক, তার ঘরে কার্তিকের মূর্তি থাকবেই।
রঙিলা বাড়ির মালেকাইন হিন্দুস্থানি। নাম সরাজুবালা। এই হিন্দুস্থানি মালেকাইনকেও চান বিবির পছন্দ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। গায়ের রঙ পাকা ডালিমের মতো। সন্ধ্যাবেলা। তিনি যখন চোখে কাজল দিয়ে সারেঙ্গি নিয়ে বসেন তখন তাকে দেখলে চান বিবির অদ্ভুত লাগে। তার কাছে মনে হয় এই মহিলা পৃথিবীর কেউ না। অন্য কোনো জগতের। তার গানের গলাও চমৎকার। মীরার ভজন গাওয়ার সময় সরাজুবালার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। এই দৃশ্য দেখেও চান বিবি মুগ্ধ।
রঙিলা বাড়িতে প্রথম ঢোকার পর মালেকাইন তাকে সামনে বসিয়ে গায়ে হাত রেখে যে কথাগুলি বলেন, সে কথাগুলি চান বিবির মনে গেথে আছে। তিনি কথা বলেন বাংলা এবং হিন্দুস্থানি মিশিয়ে। সেই কথাও চান বিবির গানের মতো লাগে।
শোন জুলেখা, তুমি রূপ নিয়ে দুনিয়াতে আসছি। গরিব ঘরের মেয়ে। এইটাই তোমার পাপ। যে নিজেই পাপ তার কপালে পাপ ছাড়া আর কী থাকবে? সে তো পাপের বাড়িতেই ঢুকবে। এই বাড়িতে পাপ কাটার ব্যবস্থা কিন্তু আছে। যে পুরুষ তোমার কাছে আসবে, সে যদি তোমার সেবায় সন্তুষ্ট হয় তাহলে তোমার কিছু পাপ কাটা যাবে। কারণ মানুষ ভগবান। মানুষকে তুষ্ট করা ভগবানকে তুষ্ট করা একই জিনিস।
তোমার রূপ আছে। সেই রূপ ধরে রাখতে হয়। রূপ ধরে রাখার নিয়মকানুন আছে। আমি তোমাকে শেখাব। তোমার যদি গানের গলা থাকে আমি তোমাকে গান শেখাব। নাচ শেখােব। যদি তোমার কপালে থাকে, তুমি বহু টাকা উপার্জন করবে। যারা তোমার কাছে আসবে, তাদের মধ্যে কারো সঙ্গে যদি আশনাই হয় তাকে বিবাহ করতে পাের। আমার কোনো অসুবিধা নাই। খাওয়া খাদ্যের মধ্যে নিরামিষ খাবে। নিরামিষ শরীর ঠিক রাখবে। শরীরই আমাদের সম্পদ- এটা মাথায় রাখবে।