ওলাদেবীর হাত থেকে বান্ধবপুরের হিন্দুদের রক্ষার জন্যে বীটকালীর মন্দিরে কালীপূজা দেয়া হয়েছে। পাঠা বলি হয়েছে। মাটির হাড়িতে পশুর রক্ত সংগ্ৰহ করা হয়েছে। সেই রক্ত দিয়ে সবাই ভক্তিভরে কপালে ফোঁটা দিয়েছে। কপালে যতক্ষণ এই রক্ত থাকবে ততক্ষণ ওলাউঠা দেবী কাছে ভিড়বে না। তিনি পূজার পশুর রক্ত পছন্দ করেন না। মন্ত্রপূত একটা কালো ছাগলের গলা সামান্য কেটে ছেড়া দেয়া হলো। যন্ত্রণাকাতর এই পশু যেদিকে যাবে তার পেছনে পেছনে যাবেন ওলাদেবী। ছাগল যদি ভিন্ন গ্রামে গিয়ে মরে যায় দেবীকে সেখানেই থাকতে হবে। এই ছাগলটা প্রথমে ছুটে গ্রাম সীমানার বাইরে গিয়েও কী মনে করে আবার ফিরে এলো। মারা গেল বাজারের মাঝখানে।
ওলাদেবীকে দূর করার জন্যে মুসলমানরাও কম চেষ্টা চালাল না। তারা গায়ে আতর মেখে ধূপকাঠি হাতে বের হলো। ওলাদেবী তাড়ানোর মুসলমানী মন্ত্র একটু ভিন্ন। দলের প্রধান বলেন—
বলা দূর যাওরে
আলী জুলফিকার
এই গেরাম ছাড়িয়া যাও
দোহাই আল্লাহর।
দলের প্রধানের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র বাকি সবাই বুক থাপড়ে জিগির ধরে –
হক নাম, পাক নাম
নাম আল্লাহর হু।
আল্লাহর নূরে নবী পয়দা
হু আল্লাহ হু।।
হরিচরণ খুব চেষ্টা করলেন ভয়াবহ এই দুর্যোগে কিছু করার জন্যে। কোনো হিন্দুবাড়িতে তিনি ঢুকতে পারলেন না। এই সময়েও জাত অজাত কাজ করতে লাগল। ওলাদেবী কিন্তু জাতিভেদ করলেন না। তিনি শূদ্রের ঘরে যেমন উপস্থিত হলেন, ব্ৰাহ্মণের ঘরেও গেলেন। দেখা গেল তার কাছে সবই সমান। ঝাপ দিয়ে পড়ল। শশী মাস্টার। যেখানেই রোগী সেখানেই তিনি। অতি আদরে রোগীর শুশ্রুষা করছেন। ডাবের পানি খাওয়াচ্ছেন। কোলে করে রোগীকে ঘর থেকে বের করছেন, আবার উঠান থেকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।
রোগের প্রকোপ সবচে’ বেশি জেলেপল্লীতে। শশী মাস্টার সেখানে উপস্থিত হতেই একজন জোড়হস্ত হয়ে বলল, বাবু আমার নামশূদ্র। আপনি ব্ৰাহ্মণ, আমাদের এখানে ঢুকবেন না।
শশী মাস্টার বললেন, কিছুদিনের জন্যে আমিও নমশূদ্র। এখন ঠিক আছে?
ওলাদেবীকে আটকানোর জন্যে প্রথম খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বান্ধবপুরের মুরুব্বিারা পরে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করল, খেয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্তটা ভুল। তাদের উচিত ওলাদেবীকে নদী পার করে দেয়া। দেবীর বিদায় মানেই রাহুমুক্তি। খেয়া বন্ধ করে দেবীকে আটকে রাখার অর্থ বিপদ মাথায় নেয়া।
দেবী দিনে চলাফেরা করেন না। উনার হাঁটাচলা সূর্য ডোবার পর। বড়গাঙে সন্ধ্যার পর খেয়া চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হলো। খেয়া পারাপার করবে শেখ মার্দ। অতি সাহসী মানুষ। তাকে বলে দেয়া হলো, ঘোমটায় মুখ ঢাকা কেউ যদি উঠে তাকে পার করতে হবে। তার সঙ্গে কোনো কথা বলা চলবে না। পারানি চাওয়া যাবে না। দেবী যেন নৌকায় উঠেন। সেই ব্যবস্থাও করা হলো। বান্ধবপুরে সন্ধ্যার পর থেকে কাসার ঘণ্টা বাজে, ঢোল খোল করতাল বাজে। মশাল হাতে লোকজন ছোটাছুটি করে।
এমন অবস্থায় রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে ঘোমটায় মুখ ঢেকে কেউ একজন শেখ মৰ্দর নৌকার পাশে এসে দাঁড়াল। অসীম সাহসী শেখ মর্দর বুক কেঁপে উঠল। সে কোনো কথা না বলে নৌকা ছাড়ল।
আকাশে মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘোমটা পরা তরুণী দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর নাম জুলেখা। একসময় সে অস্ফুট স্বরে বলল, কী সৌন্দর্য গো! কী সৌন্দর্য
ঠিক একই সময় জুলেখার বয়সি একটা মেয়েও জাহাজে করে আটলান্টিক পার হচ্ছিল। সে একা একা জাহাজের ডেকে বসেছিল। সেও মহাসাগরের শোভা দেখে জুলেখার মতোই মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল— কী সুন্দর! কী সুন্দর!
মেয়েটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মাদাম কুরি। তিনি রেডিও অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ট্রাষ্টের আমন্ত্রণে বেড়াতে যাচ্ছেন আমেরিকায়।
আমাদের জুলেখার সেই বৎসর স্থান হলো কেন্দুয়ার বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীতে। স্থানীয় ভাষায় যার নাম রঙিলা নটিবাড়ি’।
————-
Encyclopedia Britanica’র প্রাচীন সংস্করণে কেন্দুয়ার উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা ছিল Kendua a place for dancing girls. আনন্দদায়িনী নর্তকীদের মিলনমেলা।
রঙিলা নটিবাড়ি
রঙিলা নটিবাড়ি সোহাগগঞ্জ বাজারের শেষ মাথায়। মাছের আড়ত পার হয়েও আট-দশ মিনিট হাঁটতে হয়। রাস্তার দু’পাশে আপনাতে গজিয়ে ওঠা বেশকিছু শিমুলগাছ। যে-কেউ দেখে ভাববে কোনো এক বৃক্ষপ্রেমী চিন্তাভাবনা করে শিমুলের সারি লাগিয়েছেন। চৈত্রমাসে শিমুলের টকটকে লাল ফুল ফোটে। দেখতে ভালো লাগে। মনে হয়। চৈত্রের তীব্ৰ উত্তাপে গাছের মাথায় আগুন লেগে গেছে।
মূল বাড়ি কাঠের। উপরে টিন। মূল বাড়ি ঘিরে এক রুমের বেশ কিছু ছোট ছোট ঘর। কাঠের মূল বাড়িটা দর্শনীয়। উচ্চতায় প্রায় দোতলা বাড়ির সমান। দরজা এবং পাল্লায় ফুল লতাপাতা আঁকা। টিনের চৌচালাতেও নকশা কাটা। লখনৌ-এর বাইজি আংগুরি অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে মূল বাড়ি তৈরি করে। এই বাড়িতে তার একটা কন্যাসন্তান হয়। তার নাম বেদানা। তিন বছর বয়সে বেদানা পানিতে ড়ুবে মারা যায়। বেদানার মৃত্যুর পর আংগুরির আর কোনো খোজ পাওয়া যায় নি। কেউ বলে আংগুরিও মেয়ের মতো পানিতে ড়ুবে গেছে। আবার কারো কারো মতে আংগুরি দেশান্তরী হয়েছে।