সুলেমান ফিরল বিছুটি পাতার বড় একটা ঝাড় হাতে নিয়ে। তার মুখভঙ্গি শান্ত। রাগের প্রথম ঝড় পার হয়েছে। প্রথম ঝড়ের পর দ্বিতীয় ঝড় আসতে কিছু সময় নেয়। সুলেমান কুপি জ্বলিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, নেংটা হইতে তোর মজা লাগে। এখন নেংটা হা।
জুলেখা বলল, না।
সুলেমান বলল, কোনো কথা না। যা করতে বললাম করবি। শাড়ি খোল।
না।
আবার বলে না! এক্ষণ খুলিবি। তোর নেংটা হওনের স্বাদ জন্মের মতো মিটায়ে দিব। শাড়ি খোল।
জুলেখা শাড়ি খুলল। সুলেমান বিছুটি পাতার বাড়ি শুরু করল। দু’হাতে মুখ ঢেকে জুলেখা পশুর মতো গোঙাতে শুরু করল। তার শরীর ফুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ফর্সা শরীর হয়েছে ঘন লাল। বিষাক্ত বিছুটি পাতার জুলুনিতে জায়গায় জায়গায় চামড়া জমে গেছে। জুলেখার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। দুটা চোখই টকটকে লাল।
সুলেমান বিছুটি পাতার ঝাড় ফেলে দিয়ে বলল, শাস্তি শেষ, এখন শাড়ি পর।
জুলেখা পশুর মতো গোঙাতে গোঙাতে বলল, শাড়ি পরব না। এই বাড়িতে আমি যতদিন থাকব নেংটা থাকব।
সুলেমান বলল, কী বললি?
জুলেখা বলল, কী বলেছি আপনি শুনেছেন। আমি বাকি জীবন এই বাড়িতে নেংটা ঘুরাফেরা করব।
সুলেমান বলল, জহিররে আনতে যাইতেছি। কাপড় পর। ঠাণ্ডা মাথায় কইরা দেখ—আমার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ হইলে শাস্তি আরো বেশি হইত।
সুলেমান ছেলেকে নিয়ে রাত ন’টার দিকে ফিরল। দরজায় খিল দেয়া। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর খিল খুলল। জুলেখা কাপড় পরে নি। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। এক হাতে কেরোসিনের কুপি নিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয় নি।
সুলেমান স্ত্রীর হাত থেকে কুপি নিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। এমন দৃশ্য ছেলের দেখা ঠিক না। জহির কাঁদতে শুরু করল।
সুলেমান চাপা গলায় বলল, তুই নেংটা থাকবি?
হুঁ।
তোরে তো জিনে ধরেছে।
ধরলে ধরেছে।
আমার ঘরে তোর জায়গা নাই।
না থাকলে চইল্যা যাব।
তোরে তালাক দিলাম। তালাক। তালাক। তালাক। এখন ঘর থাইকা যাবি। নেংটা অবস্থায় যাবি।
জুলেখা স্বাভাবিক গলায় বলল, আচ্ছা।
মাওলানা ইদরিসের জ্বর আরো বেড়েছে। শরীর এবং হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আরেকবার বমি আসছে। দ্বিতীয়বার বিছানা নষ্ট করা কোনো কাজের কথা না। তিনি অনেক কষ্টে হারিকেন হাতে দরজা খুলে বারান্দায় এসে খুঁটি ধরে বসলেন। শরীর উল্টে বমি আসছে, তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। মনে হচ্ছে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন এবং আজ রাত্রিতেই তাঁর মৃত্যু হবে।
শরীরের এই অবস্থায় তাঁর মনে হলো, অতি রূপবতী এক নগ্ন তরুণী। উঠানের কাঁঠাল গাছের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শয়তান তাকে ধান্ধা দেখাতে শুরু করেছে। মৃত্যুর সময় তিনি যাতে আল্লাহখোদার নাম নিতে না পারেন শয়তান সেই ব্যবস্থা করেছে। পরীর মতো এক মেয়ের রূপ ধরে এসেছে।
মাওলানা ইদরিস বললেন, হে আল্লাহপাক, তুমি আমাকে শয়তানের ধোকা থেকে রক্ষা কর। তিনি আয়াতুল কুরসি পাঠ শুরু করলেন। তাঁর দৃষ্টি কাঁঠাল গাছের দিকে। মেয়েটা এখনো আছে। মাওলানা ভীত গলায় বললেন, তুই কে?
নগ্ন মেয়ে কাঁঠাল গাছের আড়ালে চলে গেল।
মাওলানা বললেন, ইবলিশ দূর হ। তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে তুই দূর হ। দূর হ কইলাম।
মেয়েটা দূর হলো না। কাঁঠাল গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। মাওলানা জ্ঞান হারালেন।
গভীর রাতে তার জ্ঞান ফিরল। তিনি বারান্দাতেই শুয়ে আছেন। তবে তার গায়ে চান্দর। মাথার নিচে বালিশ। তারচেয়ে আশ্চর্য কথা, শয়তানরূপী মেয়েটা আছে। হারিকেন হাতে তাঁর পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার গায়ে বিছানার চাদর জড়ানো।
মাওলানা ভীত গলায় বললেন, তুমি কে?
মেয়েটা জবাব দিল না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।
মাওলানা দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না। কী সুন্দরই না মেয়েটার মুখ! বেহেশতের হুরদের যে বর্ণনা আছে। এই মেয়ে সে-রকম। মাওলানা আবারো বললেন, তুমি কে?
মেয়েটা বলল, আমি জুলেখা।
মাওলানা বিড়বিড় করে বললেন, জুলেখা। জুলেখা। জুলেখা। কোরান মজিদে জুলেখার কথা উল্লেখ না থাকলেও তাঁর স্বামী নবি ইউসুফের কথা অনেকবার বলা হয়েছে।
মেয়েটা বলল, আপনের কলেরা হয়েছে।
মাওলানা বললেন, জুলেখা, পানি খাব।
জুলেখা বলল, কলেরা রোগীরে পানি দেওয়া যায় না। পানি খাইলে রোগ বাড়ে।
মাওলানা বললেন, পানি খাব। জুলেখা পানি খাব।
জুলেখা ঘরে ঢুকে গেল। মাওলানার মনে হলো, শয়তান তাকে নিয়ে যে খেলা দেখাচ্ছিল সেই খেলার অবসান হয়েছে। মেয়েটা ফিরবে না।
মেয়েটা কিন্তু ফিরল। হাতে কাসার গ্রাস নিয়ে ফিরল। মাওলানা আবার বমি করতে শুরু করলেন। জুলেখা তাকে এসে ধরল। মাওলানা বললেন, তুমি কে গো?
জুলেখা জবাব দিল না।
বাজারের দিক থেকে কাসার ঘণ্টা বাজার শব্দ শুরু হয়েছে। খুব হৈচৈ হচ্ছে। কেউ একজন মারা গেছে কলেরায়। ঘণ্টা বাজিয়ে ওলাউঠা দেবীকে দূরে সরানোর চেষ্টা। দেবী একবার যখন এসেছেন এত সহজে যাবেন না। তিনি এসেছেন মায়ের বাড়ির দেশে।
ওলাউঠা দেবী কোনো সহজ দেবী না। বড়ই কঠিন দেবী। তিনি যখন দেখা দেন অঞ্চলের পর অঞ্চল শেষ করে দেন। শীতলা দেবীর মতো তিনি তার চেহারা দেখান না। তিনি ঘোমটায় মুখ আড়াল করে হাঁটেন। হৈচৈ পছন্দ করেন না। ধূপ ধোনার গন্ধ পছন্দ করেন না। তাঁর সবচেয়ে অপছন্দ নদী। শীতলা দেবী যেমন অনায়াসে নদীর পানির উপর দিয়ে হেঁটে চলে যান, তিনি তা পারেন না। তাকে খেয়ামাঝির সাহায্য নিয়ে নদী পারাপার করতে হয়।