জুমার নামাজ শেষ করে মাওলানা নিজের ঘরে ফিরেছেন। আজকের দিনটি স্মরণে যেন থাকে। এইজন্যে বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা লিচুগাছের চারা লাগালেন। গাছ বড় হবে’। একসময় ফল আসবে। নবিজি গাছ রোপণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। একবার এক হত্যাঅপরাধীর মৃত্যুদণ্ড রদ করে গাছ রোপণের দণ্ড দিয়েছিলেন। তার শাস্তি হয়েছিল সে একশ’ খেজুর গাছ লাগবে এবং প্রতিটি গাছকে সেবাযত্নে ফলবতী করবে।
এই অঞ্চলে লিচুগাছ নেই। হিন্দুবাড়িতেও নেই, মুসলমান বাড়িতেও নেই। লোকজ বিশ্বাস— বসতবাড়ির আশেপাশে লিচুগাছ লাগানো যাবে না। লিচুগাছ মানুষকে নির্বংশ করে।
মাওলানার চালাঘরটা সুন্দর। উঠানে একটা পাতা পড়ে নেই। দু’বেলা এই উঠান মাওলানা নিজে ঝাঁট দেন। সপ্তাহে একদিন গোবর-মাটির মিশ্রণ লেপে দেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর ইসলাম ধর্মে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
লিচুগাছ লাগানোর পরপরই মাওলানা অনুভব করলেন তাঁর জ্বর আসছে। শরীর কেমন যেন করছে। গা গুলাচ্ছে। বমি আসছে। আজকের দিনের অতিরিক্ত উত্তেজনায় কি এমন হচ্ছে? মাওলানা ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন। দীর্ঘ কয়েক বছর পর আজ প্রথম তাঁর আসরের নামাজ কাজা হলো। মাগরেবের নামাজ কাজা হলো। বমি করে তিনি ঘর নষ্ট করলেন, নিজের পায়জামা-পাঞ্জাবি নষ্ট করলেন।
একজন কোরানে হাফেজ অপবিত্র থাকতে পারেন না। তাকে সবসময় অজুর মধ্যে থাকতে হবে। কারণ তাঁর শরীরে পবিত্র কোরান মজিদ। তিনি জ্বর গায়েই গোসল করলেন। ধোয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলেন।
সুলেমানের বাড়ি অন্ধকার। সন্ধ্যার পরপর বাড়িতে আলো দিতে হয়। সন্ধ্যায় আলো না দিলে বসতবাড়িতে ভূত-প্ৰেত ঢোকে। খারাপ বাতাস কপাটের পেছনে স্থায়ী হয়ে যায়। সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা বাড়ির পেছনের উঠানের জলচৌকিতে বসে আছে। তার হাতের কাছে কুপি, সে এখনো কুপি ধরায় নি। সন্ধ্যা থেকে কাদছিল, এখন কান্না বন্ধ। গালে পানির দাগ বসে গেছে। আজ তাকে কঠিন শাস্তির ভেতর দিয়ে যেতে হবে তা সে জানে। শাস্তি কী হবে জানে না বলেই অশান্তি।
আজ সে অপরাধও করেছে গুরুতর। দুপুরে যখন ঘরে কেউ ছিল না। (সুলেমান গেছে হাটে। তার পুত্ৰ গেছে হরিচরণের বাড়িতে হাতি দেখতে।) তখন সে বাড়ির পেছনের পুকুরে গোসল করতে গেল। পুকুর ঠিক না, বড়সড় ডোবা। বর্ষায় পানি হয়। সুলেমান কাঠের কয়েকটা গুড়ি ফেলে ঘাটের মতো করে দিয়েছে। ডোবার চারদিকেই ঘন জঙ্গল। আরু রক্ষার আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। জুলেখা গোসল করতে ঘাটে গেল। পানিতে নামল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। গায়ে কোনো কাপড় ছাড়া পানিতে ভেসে থাকার অন্যরকম আনন্দ। কেউ তো আর দেখছে না।
জুলেখা অতি রূপবতীদের একজন। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। শঙ্খর মতো শাদা গা থেকে অলো ঠিকরে আসছে। খাড়া নাক আজ অনেক তীক্ষ্ণ লাগছে। বড় বড় চোখ। ছায়াদায়িনী দীর্ঘ পল্লব যেন আরো গাঢ় হয়েছে। পান না খেয়েও ঠোঁট লাল। মাথার চুল ঈষৎ পিঙ্গল। সেই চুল নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত।
বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়া জুলেখার নিষেধ। বাপের দেশে নাইয়র যাওয়াও নিষেধ। বিয়ের পর সে একবার মাত্র তিনদিনের জন্যে বাপের দেশে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। যেতে হয়েছে বোরকা পরে। সুলেমান কঠিন নিষেধ করে দিয়েছিল, পুরুষ আত্মীয়ের সামনেও বোরকার মুখ খোলা যাবে না। বাবা এবং ভাইদের সামনে খোলা যেত। জুলেখার বাবা কোথায় কেউ জানে না। ভাই যারা তারা সৎ মায়ের গর্ভের, কাজেই বোরকার মুখ খোলার প্রয়োজন পড়ছে না।
হাট থেকে সুলেমান ফেরে সন্ধ্যায়। সেদিন কোনো কারণে বা ইচ্ছা করেই সে হাটে না গিয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরল। বসত বাড়ির সদর দরজা দিয়ে সাড়াশব্দ করে না। ঢুকে ঢুকল বাড়ির পেছন দিয়ে। চুপি চুপি ঘাটলার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। কী দেখছে সে! জুলেখা সাঁতার কাটছে। চোখ বন্ধ করে চিৎ সাতার দিচ্ছে। তার নগ্ন শরীরের পুরোটাই পানির উপর ভাসছে। গুনগুন শব্দও আসছে। গান করছে না-কি! সুলেমান চাপা গর্জন করল— এই বান্দি! তুই করস কী?
মুহুর্তের মধ্যে জুলেখা পানিতে ড়ুব দিল। মানবী জলকন্যা না, দীর্ঘ সময় সে জলে ড়ুবে থাকতে পারে না। জুলেখাকে ভেসে উঠতে হলো। সে অতি দ্রুত গায়ে কাপড় জড়াল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে সে তাকাল সুলেমানের দিকে।
সুলেমান বলল, কারে শরীর দেখানোর জন্যে নেংটা হইছস?
জুলেখা বলল, কাউরে দেখানোর জন্যে না।
সুলেমান বলল, মিথ্যা বইল্যা আইজ পার পাবি না। অবশ্যই কেউ আছে। তারে খবর দেয়া আছে। সে জংলার কোনো চিপায় আছে। তার নাম বল।
এমন কেউ নাই।
মুরগি যেমন জবেহ করে তোর গলা সেই মতো কাটব। নাম বল। তুই তো কারণে অকারণে ঐ হিন্দুর বাড়িতে বইসা থাকাস। তার ঘর ঠিক করাস। উঠান ঝাড় দেস। তার সাথে তোর কী?
উনারে আমি বাবা ডেকেছি। উনার বিষয়ে কিছু বলবেন না।
মালাউন হইছে তোর বাবা? আমারে বাবা শিখাস?
জুলেখা চুপ করে গেল। রাগে উন্মাদ একজন মানুষের সঙ্গে যুক্তি তর্ক করা অর্থহীন। সুলেমান দা হাতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটে বসে রইল। দু’জন মুখোমুখি বসা। জহির এখনো ফিরে নি। এটা ভালো। হরিবাবুর বাড়িতে আরো কিছুক্ষণ থাকুক। হাতি দেখবে। খেলবে। রাতে তাকে নিয়ে আসবে। সবচে’ ভালো হয় রাতে ছেলে ঐ বাড়িতে যদি থেকে যায়। এখানে কী ঘটনা ঘটবে কিছুই বলা যায় না। খুন খারাবিও হয়ে যেতে পারে। পুলাপানদের এইসব দেখা ঠিক না।