জুলেখা জবাব না দিয়ে ছেলের অন্যপায়ে আরেকটা মাছ আঁকছে। সুলেমান বলল, পুরুষ মাইনষের পাও আলতা দিতাছ?
জুলেখা বলল, জহির পুলাপান। পুলাপানের পায়ে আলতা দিলে দোষ হয় না।
এই কথা কোন বুজুর্গ আলেম তোমারে বলেছে?
জুলেখা জবাব দিল না। স্বামীর বেশিরভাগ প্রশ্নেরই সে জবাব দেয় না।
সুলেমান বলল, জহিররে নিয়া জুম্মার নামাজ পড়তে যাব। তখন যদি পাও রাঙা থাকে–
জুলেখা ফিক করে হেসে ফেলল।
সুলেমান বলল, হাসলা যে? কী কারণে হাসলা?
জুলেখা বলল, কী কারণে হাসছি আপনেরে বলব না।
জুলেখা হাসছে কারণ সে তার স্বামীকে ভালো ফাঁকি দিয়েছে। তাকে না। জানিয়ে লেখাপড়া শিখে ফেলেছে। যে-কোনো লেখা সে এখন পড়তে পারে।
সুলেমান বলল, তুই অবশ্যি বলবি।
তুই তোকারি কইরেন না।
সুলেমান কঠিন গলায় বলল, আগে বল তুই হাসলি কী জন্যে? হাসির কথা কী হইছে?
জুলেখা কিছুই বলল না, নিজের মনে পায়ে আলতা দিতে লাগল। সুলেমান মুড়ি খাওয়া বন্ধ করে উঠে এলো। প্রথমে ভেবেছিল স্ত্রীর গালে কষে থাপ্লড় দিবে। বেয়াদব স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার সব স্বামীর আছে। মাওলানা সাহেব বলেছেন আল্লাহপাক পুরুষ মানুষরে এই অধিকার দিয়েছেন। কারণ পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে। তবে শাসনের সময় খেয়াল রাখতে হবে স্ত্রীর মুখমণ্ডলে যেন মারের চিহ্ন না থাকে। সুলেমান থাপ্পড় উঠিয়ে এগিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। থাপ্পড় দেবার বদলে আলতার শিশি উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
জুলেখার একপায়ে আলতা দেয়া হয়েছে। অন্য পা খালি। আবার কবে আলতা কেনা হবে, কবে পায়ে দেয়া হবে কে জানে! বেদেবহর নৌকা করে এখনো আসে নি। তারা চলে এলে সমস্যা নেই। গাইন বেটির ঝুড়ি ভর্তি করে কাচের চুড়ি, আলতা, গন্ধতেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। বাহারি জিনিস বেচবে। একইসঙ্গে কাইক্যা মাছের কাটা দিয়ে শরীরের বন্দ রক্ত দূর করবে। গাইন বেটিদের কাছ থেকে শখের জিনিসপত্র কেনার জন্যে এবং বাদ রক্ত বের করার জন্যে সব মেয়েই টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখে। জুলেখারও জমা টাকা আছে।
সুলেমান বলল, ঝিম ধইরা বইসা থাকবা না। ছেলের পাওয়ের আলতা ঘইসা তোলা। আইজ জুম্মাবার। নামাজে যাব। ছেলেরে ঘাটে নিয়ে যাও। রিঠা গাছের পাতা দিয়া ডলা দাও।
জুলেখা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ছেলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছেলের দুই পায়ে দুই মাছ। কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে মাছ দুটা! এই সুন্দর দুটা মাছ তুলে ফেলতে হবে? কাজটা বড়ই কঠিন। সুন্দর নষ্ট করা যায় না। সুন্দর নষ্ট করলে পাপ হয়। এই কথা তার ব্যাপজান তাকে বলেছিলেন।
পুকুরঘাটে পা ড়ুবিয়ে জহির বসেছে। জুলেখা তার সামনে। জুলেখার হাতে গায়ে মাখা গন্ধ সাবান। এই সাবান গত বছর গাইনবেটিদের কাছ থেকে কেনা, গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা। সুলেমান এত দামের সাবান দেখতে পেলে রাগবে।
জহির বলল, মা গীত কর।
কোন গীত?
পাও ধুয়ানি গীত।
জুলেখা সঙ্গে সঙ্গে গাইল—
সোনার পায়ে সোনার মাছ
বিলমিল বিলমিল করে।
এই মাছেরে দিয়ে আসব
দক্ষিণ সায়রে।
গানের কথাগুলি জুলেখা এখনই তৈরি করল। তার এত ভালো লাগল। তার বাপজানের গুণ কি তার মধ্যে আছে? কোনোদিন কি সে তার ব্যাপজানের মতো মুখে মুখে গান বাঁধতে পারবে?
মাওলানা ইদরিস খুতবা পাঠ শেষ করলেন। মুসুল্লিদের দিকে তাকালেন। মাত্র নয়জন। তাঁর হিসেবে আরো বেশি হবার কথা। কাঠমিন্ত্রি সুলেমান তার পুত্ৰকে নিয়ে এসেছে। এটা ভালো। সুলেমান সবসময় আসে না। মাঝেমধ্যে একা আসে, ছেলেকে আনে না। শিশুদের শুরু থেকেই ধর্মকর্মে আগ্রহী করা পিতামাতার কর্তব্য। যে পিতা-মাতা এই কর্তব্যে অবহেলা করবেন। রোজ হাশরে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির বিধান আছে।
মাওলানা বললেন, আপনাদের জন্য সামান্য শিন্নির ব্যবস্থা আছে।
মাওলানা শিন্নির হাঁড়ি এবং চামচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুসুল্লিরা কলাপাতা হাতে নিলেন। নবিজি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। নবিজির পছন্দের জিনিস করা তার উম্মতের জন্যে সোয়াবের কাজ।
শিন্নি মাওলানা নিজেই তাঁর বাড়িতে প্ৰস্তুত করেছেন। দুধ, আলোচল, গুড়, সঙ্গে কিছু কিশমিশ এবং তেজপাতা। খাঁটি দুধ। দীর্ঘসময় জ্বাল হয়ে অপূর্ব স্বাদু বস্তু তৈরি হয়েছে। সবাই আগ্রহ করে খাচ্ছে। মাওলানা দ্বিতীয়বার শিন্নি দিতে দিতে বললেন, আল্লাহপাক আমার উপর বড় একটা দয়া করেছেন বলেই এই শিন্নির ব্যবস্থা। আপনারা আমার জন্যে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করবেন। সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কেউ জানতে চাইল না— বড় দয়াটা কী?
মাওলানা নিজেই খোলাসা করলেন। তিনি কোরান মজিদ পুরোটা মুখস্থ করেছেন। এখন তাকে কোনো আলেম হাফেজের কাছে যেতে হবে। তাকে কোরানমজিদ মুখস্থ শোনাতে হবে। হাফেজ সাহেব যদি বলেন ঠিক আছে, তাহলে নামের শুরুতে তিনি হাফেজ টাইটেল ব্যবহার করবেন। তার টাইটেল হবে হাফেজ মাওলানা ইদরিস।
জীবনের একটা আকাঙ্ক্ষাই তখন অপূর্ণ থাকবে- নবিজির মাজার জেয়ারত। হজ্ব তাঁর জন্যে ফরজ না। তিনি বিত্তহীন সামান্য মাওলানা। হজে তাঁর না গেলেও হবে, কিন্তু নবিজির মাজার জেয়ারত করা তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। তিনি নবিজির মাজারের কাছে যাবেন, দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলবেন, হে জগতের আলো, পেয়ারা নবি! আসসালামু আলায়কুম। আমি আল্লাহপাকের নাদান বান্দা গুনাগার ইদরিস। যে পাক কোরান। আপনার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছে সেই পাক কোরান। আমি মুখস্ত করেছি। আমার দিলের একটা খায়েশ আপনেরে কোরান মজিদ আবৃত্তি করে শোনাব। যদি অনুমতি দেন।