জুলেখা বিস্মিত হয়ে বলল, এতটা রস একসঙ্গে খাবেন?
কোনো অসুবিধা নাই, দুপুরে ভাত খাব না।
হরিচরণ তৃপ্তি করে বাটিভর্তি ঘন খেজুরের রস শেষ করলেন। পুকুরের পানিতে ঠোঁট ধুতে ধুতে বললেন, মা, তুমি নানান সময়ে নানান ভাবে আমার সেবা করছি। তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। কী পেলে তুমি খুশি হবে?
জুলেখা জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলে, আমাকে একটা কলের গান কিনে দেন। এই যন্ত্রটার জন্যে আমি আমার জীবন দিয়ে দিতে রাজি। কী অদ্ভুত জিনিস! পিতলের এক চোঙ। চোঙের ভেতর দিয়ে আসে কী সুন্দর গান। একটা গান ইচ্ছা করলে দশবার শোনা যাবে। সুরে ভুল হবে না। তালে ভুল হবে না। বাজনায় ভুল হবে না। কী আজব যন্ত্ৰ! ইশ সে যদি তার বাপজানকে যন্ত্রটা দেখাতে পারত!
হরিচরণ বললেন, তোমার মনের মধ্যে কিছু আছে, বলে ফেল।
জুলেখা বলল, মনের মধ্যে কিছু নাই। বলতে বলতে সে হরিচরণের পাশে বসল। হরিচরণ বললেন, এই হাঁসের একটা নাম আছে, সেটা জানো?
জুলেখা বলল, না। এর নাম ‘দেশান্তরী পাখি’। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়, এই জন্যেই দেশান্তরী।
জুলেখার মনে হলো— কী সুন্দর নাম! দেশান্তরী। পাখিদের মতো দেশান্তরী মানুষও তো আছে যাদের কাজ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া। তার নিজের বাবাও তো দেশান্তরী। জুলেখার ইচ্ছা করছে দেশান্তরী দিয়ে একটা গান লেখে। প্রথম লাইন—
দেশান্তরী বান্ধই গো, কোন দেশেতে যাও?
পরের লাইনটা মাথায় আসছে না। সে যদি লেখাপড়া জানত এই লাইনটা লিখে রাখত। লেখাপড়া শেখা খুব কি জটিল? সে কোরান মজিদ পাঠ করতে পারে। লিখতে পারে না।
হরিচরণ বললেন, জুলেখা, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও? বলতে চাইলে বলো।
জুলেখা মাথা নিচু করে বলল, আমি বাংলা লেখা বাংলা পড়া শিখতে চাই।
হরিচরণ বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকা তরুণীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি নিজে তোমাকে শেখাব। তুমি তোমার স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখবে। মুসলমানদের মধ্যে এই বিষয়টা দেখেছি। তারা স্ত্রীদের লেখাপড়া পছন্দ করে না।
জুলেখা বলল, স্ত্রী লেখাপড়া শিখলে স্বামীর হায়াত কমে, এইজন্যে পছন্দ করে না।
এইসব তো ভুল কথা।
সবাই জানে ভুল কথা, তারপরও ভুল কথাই মানে।
তুমি সুলেমানকে আমার কাছে পাঠাবা, আমি তারে বুঝায় বলব।
সে দেশে নাই। মৈমনসিং গেছে কমে। ফিরতে একমাস লাগব। আমি কি এর মধ্যে শিখতে পারব না?
হরিচরণ কিছুক্ষণ জুলেখার দিকে তাকিয়ে বললেন, অবশ্যই পারবা। বলো—অ।
জুলেখা বলল, অ।
এখন বলো, আ।
জুলেখা বলল, আ।
এক টুকরা কয়লা আনা। আমি অক্ষর দুইটা লিখব। আজ সন্ধ্যায় তোমার জন্যে বাল্যশিক্ষা কিনে আনব।
জুলেখা এক টুকরো কয়লা এনেছে। শ্বেতপাথরে সেই কয়লার দাগ বসছে না। হরিচরণ উঠে দাঁড়ালেন। ঘাটে বসে থাকার পরিকল্পনা তিনি বাদ দিয়েছেন। তিনি বাজারে যাবেন। মেয়েটার জন্যে প্লেট পেন্সিল কিনবেন। বাল্যশিক্ষা কিনবেন।
হরিচরণ ঘাট থেকে যাবার কিছুক্ষণ পরই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। দিঘিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস নামতে শুরু করল। দেখতে দেখতে দিঘি হাঁসে পূর্ণ হলো। অদ্ভুত দৃশ্য। যেন দিঘিতে হাঁসের সর পড়েছে। সেই সার উঠানামা করছে। হাঁসদের কারণে দিঘি থেকে হোঁ হোঁ হোঁ, জাতীয় গম্ভীর ধ্বনি উঠছে।
একই সময় বাবু মনিশংকরের বাড়ি থেকে অসময়ে শাখের শব্দ হতে লাগল। মনিশংকরের এক জেঠির ভেদ বমি শুরু হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে দেবী ওলাউঠার দয়া। দেবীকে দূর করার জন্যেই শঙ্খধ্বনি। অদ্ভুত শব্দ আসছে শঙ্খ থেকেও। ভোঁ ভোঁ ভোঁ। যেন দূর থেকে লঞ্চ ভোঁ দিচ্ছে। শঙ্খের শব্দের সঙ্গে হাসের শব্দ মিলে একাকার হয়ে গেল।
সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা আয়োজন করে পায়ে আলতা দিচ্ছে। সে বসেছে বেতের মোড়ায়। তার পা জলচৌকিতে রাখা। পাটকাঠির মাথা কলমের নিচের মতো কেটে তুলি বানানো হয়েছে। জহির মুগ্ধ চোখে মা’র পায়ের শিল্পকর্ম দেখছে। একটু দূরে ছোট ধামা ভর্তি মুড়ি এবং খেজুর গুড় নিয়ে বসেছে সুলেমান। সে তিন দিন হলো ফিরেছে। স্ত্রীর জন্যে। কচুয়া রঙের একটা শাড়ি এনেছে। এই বিষয়ে স্ত্রীর কোনো উৎসাহ নেই দেখে আহত হয়েছে। জুলেখা সেই শাড়ির ভাজ এখনো খুলে নি। নতুন শাড়ি পেয়ে কদমবুসি করা প্রয়োজন, তাও করে নি। তার পুত্র জহির মুড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে মায়ের সাজ দেখছে, এতেও সুলেমান মহা বিরক্ত। আজ জুম্মাবার। জুম্মাবারে এত সাজসজ্জা কী?
সুলেমান জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ পুলা, মুড়ি খাইয়া যা।
জহির মা’র দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই গম্ভীর গলায় বলল, না।
জুলেখা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, পাও আলতা দিতে ইচ্ছা করে?
জহির সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার ছোট্ট পা জলচৌকিতে তুলে দিল। জুলেখা ছেলের পায়ে লাল টুকটুকে একটা মাছ। এঁকে দিল। জহিরের মুখভর্তি হাসি।
রাগে সুলেমানের শরীর জুলে যাচ্ছে। ছেলেকে নিয়ে সে জুম্মার নামাজ পড়তে যাবে, এর মধ্যে পায়ে আলতা! তার উচিত ছেলের গালে শক্ত করে একটা চড় দেয়া। এটা সে করতে পারছে না। জহিরের শরীর ভালো না। কালরাতেও জ্বর ছিল। এখনো হয়তো আছে।
সুলেমান বলল, সক্কালবেলা আলতা নিয়া বসিলা। কাজটা উচিত হয়েছে?
জুলেখা বলল, সক্কালে আলতা দেওয়া যাবে না। এমন কথা কি হাদিস কোরানে আছে?
এইটা কেমন কথা? তোমার উপরে কি জিন ভূতের আছর হইছে? জিন ভূতের আছর হইলে মেয়েছেলে স্বামীর মুখের উপরে ফড়িফড় করে। জঙ্গলায় ঘুরে। সময় অসময়ে গীত ধরে।