কলের গান দেখার জন্যে?
হুঁ।
আপনার নাম জানতে পারি? আজ কি আপনি আপনার নামটা বলবেন?
জুলেখা।
মুসলমান?
হুঁ।
গান খুব পছন্দ করেন?
জুলেখা হঁহা-সূচক মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আপনি নিজে একটা বাজনা বাজান আমি দেখছি। বেঞ্জো।
হ্যাঁ, ব্যাঞ্জো।
আপনার বাজনা ভালো না। তাল কাটে।
আপনি কি গান গাইতে পারেন?
হুঁ।
আমি কি আপনার একটা গান শুনতে পারি?
না। কলের গানটা বাজান। আমি দেখি।
শশী মাস্টার কলের গান চালু করলেন। মীরার ভজন হচ্ছে। শশী মাস্টার অবাক হয়ে লক্ষ করলেন- গান শুনতে শুনতে এই অস্বাভাবিক রূপবতী মেয়েটি চোখের পানি ফেলছে।
শশী মাস্টার বললেন, কলের গানটা আপনি নিয়ে যান। আমি আপনাকে দিলাম। উপহার।
জুলেখা বলল, আপনার জিনিস। আমি নিব কী জন্যে? আপনে আমার কে?
আরেকটা থাল দিব? অন্য গান।
জুলেখা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
সেই রাতে হারিকেন জ্বলিয়ে শশী মাস্টার ডায়েরি লিখতে বসলেন- What a shame! I am deeply in love with the muslim lady—মুনিগণ ধ্যান ভেঙে দেয় পয়ে তপস্যার ফল।
অনেক রাতে শশী মাস্টার একটি কবিতাও লিখলেন–
এক জোড়া কালো আঁখি; এত মূল্য তারি!
নিতান্ত পাগল ছাড়া কে করে প্রত্যয়?
জগতের যন্ত রত্ন লাজে মানে হারি—
বিনিময়ে দিতে পারি, যা কিছু সঞ্চয়!
অনেকদিন পর হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ইসলামি গান’ শিরোনামে রূপবতী জুলেখার একটি রেকর্ড প্রকাশ করে। সেখানে তার নাম লেখা হয় চান বিবি। গানের প্রথম কলি- ‘কে যাবি কে যাবি বল সোনার মদিনায়।” সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে। এই ফাঁকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থাটা বলে নেই। সম্রাট পঞ্চম জর্জ এবং রানী মেরী বেড়াতে এসেছেন ভারতবর্ষে (ডিসেম্বর, ১৯১১)। তাঁদের সম্মানে দিল্লিতে এক মহা দরবার অনুষ্ঠিত হলো। সেই দরবারে সম্রাট হঠাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করলেন। মুসলমানরা মর্মাহত। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্যে যে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ইংরেজের প্রিয়পাত্র হয়েও তিনি বঙ্গভঙ্গের কঠিন সমালোচনা করলেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন আইনজীবী মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলি, মাওলানা জাফর আলি খান। রাজনীতির আসরে এই সময় যুক্ত হয়েছেন বরিশালের চাখার থেকে আসা এক তরুণ। তার নাম এ কে ফজলুল হক।
কার্তিক মাসের শেষ
কার্তিক মাসের শেষ।
উত্তরের গারো পাহাড় থেকে শীতের হিমেল হাওয়া উড়ে আসতে শুরু করেছে। এবারের লক্ষণ ভালো না। মনে হয় ভালো শীত পড়বে। দু’বছর পরপর হাড় কাঁপানো শীত পড়ে। গত দু’বছর তেমন শীত পড়ে নি।
হরিচরণ চাদর গায়ে পুকুরপাড়ে এসে বসেছেন। তাঁর মন বেশ খারাপ। তিনি খবর পেয়েছেন ধনু শেখের দোতলা লঞ্চে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভেদবমি করতে করতে একজন মারা গেছে। বান্ধবপুরে কলেরা এসে ঢুকেছে। গ্রামের পর গ্রাম শূন্য করে দেয়া এই ব্যাধির কাছে মানুষ অসহায়। তিনি মনে মনে বললেন, দয়া কর দয়াময়। যেন দেবী ওলাউঠা লঞ্চে করে বান্ধবপুর না নামেন। তার প্রার্থনার সময় বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটল। তার দিঘিতে একজোড়া শীতের হাঁস নামল। শীতের পাখি নামে হাওরে, মনে হচ্ছে এই প্রথম কোনো দিঘিতে নামল। দিঘিও এমন কিছু বড় দিঘি না। এরা কি মনের ভুলে নেমে পড়েছে? নাকি কোনো কারণে দলছুট হয়েছে? দলছুট হবার সম্ভাবনাই বেশি।
দুটি হাঁসের একটি পানিতে স্থির হয়ে আছে। অন্যটি একটু পরপর ড়ুব দিচ্ছে। এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত, ঘটনা কী?
হরিচরণ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। দুটা পাখিই ঘাটের কাছে। ভয় পেয়ে ওদের উড়ে যাওয়া উচিত, তা গেল না। সম্ভবত এরা মানুষ দেখে অভ্যস্ত না। মানুষ যে বিপদজনক প্রাণী এই তথ্য এখনো জানে না। হরিচরণ বললেন, তোদের সমস্যা কী রে? একটা হাঁস তার দিকে তাকাল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ ক্লান্ত। রোগা শরীর। দুই থেকে আড়াই মাস এরা থাকবে। মোটাতাজা হয়ে দেশে ফিরে যাবে। একটা পাখি তার একজীবনে কতবার আসা যাওয়া করে এই তথ্য কি কেউ জানে? হরিচরণ ঠিক করে ফেললেন গদিতে পৌঁছেই পাখিবিষয়ক কোনো বইপত্র পাওয়া যায় কি-না জানতে চেয়ে কোলকাতায় চিঠি লিখবেন। ‘মানব বুক হাইস’ নামে একটা বইয়ের দোকানের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। তার প্রয়োজনীয় বইপত্র এরাই পাঠায়।
জুলেখা বাটিভর্তি খেজুরের রস নিয়ে এসেছে। নিজেদের গাছের রস। সে জ্বল দিয়ে ঘন করেছে। অপূর্ব ঘ্রাণ ছেড়েছে। খেজুরের রস খেজুরপাতা দিয়ে জ্বাল না দিলে ভালো ঘ্ৰাণ হয় না। জুলেখা খেজুরপাতা দিয়েই রস জ্বাল দিয়েছে।
জুলেখা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, আপনার জন্যে খেজুরের রস আনছি।
ভালো করেছ। রস ভালো হয়েছে। সুঘ্ৰাণ ছেড়েছে। তাকিয়ে দেখ দিঘিতে দুটা হাঁস নেমেছে।
ও আল্লা। কী আচানক! আরো কি নামবে?
নামতে পারে। সব পশুপাখি নিজেদের ভেতর যোগাযোগ রাখে। এই দুটা পাখি হয়তো অন্যদের খবর দিবে। আমি ঠিক করেছি আজ আর গদিতে যাব না। ঘাটে বসে থাকব। দেখি আরো পাখি নামে কি-না।
জুলেখা মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলল, বাবা, আপনি আজব মানুষ।
হরিচরণ বললেন, আমরা সবাই আজব মানুষ। তুমি আজব, তোমার ছেলে আজব, তোমার স্বামী আজব। ঈশ্বর নিজে আজব, সেই কারণে তিনি আজব জিনিস তৈরি করতে পছন্দ করেন। রসের বাটিটা দাও, এক চুমুকে খেয়ে ফেলি।