শশী ভট্টাচার্যের হঠাৎ মনে হলো, এ কোনো মানবী না। নিশ্চয়ই স্বর্গের উৰ্বশীদের কেউ। কিংবা দেবী স্বরস্বতী স্বয়ং মর্তভূমে নেমে এসেছেন। শশী ভট্টাচার্য বললেন, কে?
তরুণী চমকে উঠল। কিন্তু জবাব দিল না। ছুটে পালিয়েও গেল না।
শশী ভট্টাচার্য বললেন, আপনি কে? এখানে কী করেন?
তরুণী নিচু গলায় বলল, গান শুনি।
আপনি কি এই অঞ্চলের?
তরুণী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শশী ভট্টাচার্য বললেন, কলের গানে গান হচ্ছে। চোঙের ভেতর দিয়ে গান আসে। একটা যন্ত্র। হাত দিয়ে দম দিতে হয়। আপনি কি যন্ত্রটা দেখবেন?
না।
আপনি কি প্রথম গান শুনতে এসেছেন? নাকি আগেও এসেছেন?
আগেও আসছি।
তরুণী চারটা আঙুল দেখাল।
শশী মাষ্টার বললেন, গান শুনতে ভালো লাগছে?
হুঁ।
আরেকটা থাল দিব!
থাল কী?
গোল থালের মতো জিনিস। যেখানে গান বাঁধা থাকে।
তরুণী বলল, গান কি দই যে বাঁধা থাকব?
একটা থাল এনে আপনাকে দেখাই? থালটা যন্ত্রের ভেতর দিয়ে হ্যান্ডল চাপলেই থাল থেকে গান হয়।
তরুণী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শশী মাস্টার বললেন, আপনার নাম কী?
নাম বলব না।
বলতে না চাইলে বলবেন না। আপনি দাঁড়ান, আমি থাল এনে দেখাচ্ছি।
তরুণী বলল, আচ্ছা।
শশী মাস্টার রেকর্ড নিয়ে এসে তরুণীকে দেখতে পেলেন না। জামগাছের নিচে কেউ নেই। আশেপাশেও নেই। কোনো এক বিচিত্র কারণে তার সারারাত ঘুম হলো না। তিনি গভীররাতে ডায়েরি খুলে লিখলেন—
I saw an Indian lady at the dead of night. Her captivating beauty was all engulfing. For a moment I lost all my senses, I felt like bowing down at her feet.
শ্রাবণ মাস। হাওরে পানি এসেছে। নদীনালা ফুলে ফোঁপে উঠছে। ধনু শেখ তার একতলা লঞ্চ বিক্রি করে দোতলা লঞ্চ কিনেছেন। এই লঞ্চের প্রধান বিশেষত্ব তার হর্ন। ঘাটে ভিড়েই এমন বিকট শব্দে ‘ভো’ দেয় যে বাজারের লোকজন চমকে উঠে। লঞ্চের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হিন্দু মুসলিমের আলাদা আসন। হিন্দুরা দোতলায়। মুসলমানরা একতলায়। কোনো মুসলমান দোতলায় উঠতে পারবে না। দোতলায় ভাতের হোটেল আছে। ব্ৰাহ্মণ বাবুর্চির হাতে হোটেল। ছয় আনায় অতি উত্তম ব্যবস্থা। পেটচুক্তি ভাত। সবজি, ডাল, ছোট মাছের চচ্চড়ি। খাওয়ার শেষে একবাটি মিষ্টি দই।
মুসলমানদের জন্যে আলাদা হোটেল নেই। যারা খেতে চায় দোতলার খাবার নিচে চলে আসে। তবে মুসলমানরা সাধারণত কিছু খায় না। তাদের এত পয়সাকড়ি নেই।
দোতলা লঞ্চ চালুর দিনও ধনু শেখ গেল নিবারণ চক্রবর্তীর কাছে। তাঁর আশীৰ্বাদ নিতে।
নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, দোতলা লঞ্চ কিনেছ খবর পাইছি। অল্পদিনে ভালো দেখাইলা।
ধনু শেখ বিনীত গলায় বলল, আপনার আশীৰ্বাদ। আপনার আশীৰ্বাদ বিনা এই কাজ সম্ভব ছিল না।
লঞ্চের নাম নাকি দিছ- জয় মা কালী সার্ভিস?
জে। কর্তা।
তুমি মুসলমান হইয়া লঞ্চের নাম দিলা জয় মা কালী?
ধনু শেখ বলল, বাতাস বুইজ্যা পাল তুলছি। হিন্দু যাত্রী বেশি। সেই কারণে হিন্দু নাম।
নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, মুসলমান যাত্রী যদি বেশি হওয়া শুরু করে তখন কি নাম পাল্টাইবা?
ধনু শেখ হাসিমুখে বললেন, অবশ্যই। তখন নাম হইব ‘মা ফাতেমা সার্ভিস’।
মা ফাতেমাটা কে?
আমাদের নবিজির কন্যা।
ভালো। ভালো। খুব ভালো।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আপনেরে লঞ্চ করে সোহাগগঞ্জ বাজারে নিয়া যাব। একটু ইজ্জত করব।
নিবারণ চক্রবর্তী বিরক্ত গলায় বললেন, ইজ্জত আমার যথেষ্টই আছে। তোমার ইজ্জতের প্রয়োজন নাই।
ধনু শেখ বলল, অবশ্যই অবশ্যই।
এই ঘটনার দু’দিন পরই নিবারণ চক্রবর্তীর দোতলা লঞ্চ সোহাগীগঞ্জে অচল হয়ে পড়ে গেল। ইঞ্জিনে যে ডিজেল দেয়া হয়েছিল। সেখানে নাকি পানি মেশানো ছিল। ডিজেল কেনা হয়েছিল ধনু শেখের দোকান থেকে। সে ডিজেল এবং কেরোসিনের ডিলারশিপ পেয়েছে। তার কাছ থেকে ডিজেল না কিনে উপায় নেই।
শশী মাস্টার ভোরবেলা ঘর ছেড়ে বের হন। মাধাই খালে একঘণ্টা সাতার কাটেন। ভেজা কাপড়েই যান স্কুলে। ভেজা কাপড় গায়ে শুকালে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এই যুক্তিতে ভেজা কাপড় গায়ে শুকান। স্কুলের ছাত্র পড়ানো শেষ করে, জমিদারির কাগজপত্র নিয়ে বসেন। দুপুরে হরিচরণের সঙ্গে ফলাহার করেন। হরিচরণের সঙ্গে টুকটাক কিছু কথাবার্তা হয়। সবই ধর্মবিষয়ক। ঈশ্বরের স্বরূপ কী? উপনিষদ বলছে- জগত মায়া। মায়ার অর্থ কী? জগৎ যদি মায়া হয়। তাহলে কি প্ৰেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতাও মায়া? শশী মাস্টারের নিজের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বরাবরই সন্ধ্যা হয়। নিত্যদিনের এই রুটিনে একদিন ব্যতিক্রম হলো। হঠাৎ জ্বর এসে যাওয়ায় স্কুল ছুটি দিয়ে বাড়ি ফিরে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। জামগাছের নিচে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি তাঁর ঘরে। কলের গানের সামনে বসে আছে। পেতলের চোঙের ভেতর চোখ রেখে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। শশী মাস্টারকে দেখে তরুণী ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শশী মাস্টার নিজের বিস্ময় গোপন রেখে বললেন, ঐ রাতে আপনাকে দেখাবার জন্যে থাল এনে দেখি আপনি নাই। চলে গেলেন কেন?
তরুণী জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।
শশী মাস্টার বললেন, কলের গান কীভাবে বাজে দেখাব?
তরুণী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শশী মাস্টার বললেন, আপনি কি আমার বাড়িতে এর আগেও ঢুকেছেন।
তরুণী হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে তিনটা আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। সে তিনবার ঢুকেছে।