মনিশংকর বললেন, মাগো, আমি আপনার পুত্র। পুত্রের কাছে মাতার লজ্জার কিছু নাই। দেবী দুর্গা আপনার জন্যে সামান্য উপহার পাঠিয়েছেন। গ্ৰহণ করলে ধন্য হবো।
জুলেখা বলল, কে পাঠায়েছেন?
আমার মাধ্যমে দেবী দুর্গা পাঠিয়েছেন।
আমি মুসলমান।
জানি। মাগো, পছন্দ করে একটা শাড়ি নেন।
জুলেখা কাঁপা কাঁপা হাতে একটা শাড়ি নিল। তার কাছে মনে হলো সে তার জীবনে এত সুন্দর শাড়ি দেখে নি। জবাফুলের মতো লালশাড়ি। আঁচলে সোনালি ফুল। ফুলগুলি থেকে সোনালি আভা যেন ঠিকরে পড়ছে। শাড়ি নিয়ে সুলেমান কোনো ঝামেলা করল না। পূজার পরে তাকে শাড়ি কিনে দিতে হবে না। এই স্বস্তিই কাজ করল।
হরিচরণের বাড়িতে মনিশংকর উপস্থিত হয়েছেন। তার হাত ধরে আছে পুত্র শিবশংকর। ছেলেটা বাবার ন্যাওটা। বাবাকে ছেড়ে একমুহুৰ্তও থাকতে পারে না। পূজাবাড়ির হৈচৈ ফেলে সে বাবার হাত ধরে ঘুরছে।
হরিচরণ ব্যস্ত হয়ে উঠানে এসে দাঁড়াতেই মনিশংকর বললেন, আমার বাড়িতে মা এসেছেন। আপনি নাই কেন?
হরিচরণ বললেন, আমি কীভাবে যাব? আমি পতিতজন।
মনিশংকর বললেন, মা’র কাছে কেউ পতিত না। আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
পূজামণ্ডপে আমি উপস্থিত হলে অন্যরা আপনাকে ত্যাগ করবে।
অন্যরা ত্যাগ করলে করবে। মা আমাকে ত্যাগ করবে না। আপনি যদি আমার সঙ্গে না যান। আমি কিন্তু আপনার উঠানে উপবাস করব।
দীর্ঘদিন পর হরিচরণের চোখে পানি এসে গেল। মনিশংকর ছেলেকে বললেন, যাও কাকাকে প্ৰণাম কর।
হরিচরণ আঁৎকে উঠে বললেন, না। না।
মনিশংকর বললেন, আপনি অতি পূণ্যবান ব্যক্তি। আপনাকে প্ৰণাম না করলে কাকে করবে!
মূল মণ্ডপের বাইরে উঠানে হাঁটুগেড়ে জোড় হস্তে হরিচরণ বসেছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। ঘণ্টা এবং ঢাকের আওয়াজ কানে আসছে। নাকে আসছে ধূপের গন্ধ। তাঁর উচিত দেবী দুর্গার বন্দনা করা। তিনি একমনে বলছেন, কৃষ্ণ কোথায়? আমার কৃষ্ণ! কৃষ্ণ।
এইসময় একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মোটামুটি অপরিচিত লোকজনের মধ্যে পরিচিত একজনকে দেখে দৌড়ে এসে তার কোলে ঝাপ দিয়ে পড়ল জহির। হরিচরণ অনেকদিন আগে দেখা স্বপ্লে ফিরে গেলেন। তার মনে হলো, সত্যি স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণ তার কোলে। জ্ঞান হারিয়ে উঠানে পড়ে গেলেন। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। পূজারি ঠাকুর ঘোষণা করলেন, ধর্মচ্যুত মানুষ দেবীর কাছাকাছি আসায় এই বিপত্তি। দেবী বিরক্তি হয়েছেন। দেবীর বিরাত্ত্বিও, দূৰ্গা করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আলাদা পূজাপাঠ লাগবে।
হরিচরণ দুর্বল শরীরে শুয়ে আছেন। তাঁকে দেখতে এসেছেন। শশী। ভট্টাচার্য। ডাক্তার কবিরাজের মতো গম্ভীর ভঙ্গিতে নাড়ি ধরে থেকে বলেছে, আপনার কি মৃগী আছে? হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মৃগীর লক্ষণ।
আমার মৃগী নাই।
নাই, হতে কতক্ষণ? সাবধানে থাকবেন। একাডোজ ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে ঘুমিয়ে থাকুন। ওষুধের কারণে সুনিদ্রা হবে। ক্লান্তি দূর হবে।
হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ডাক্তারি কর না-কি?
শশী ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমি শখের চিকিৎসক। বায়োকেমিক চিকিৎসা করি। বায়োকেমিক চিকিৎসা বিষয়ে কি আপনি কিছু জানেন?
না।
আমাদের বায়োকেমিক শাস্ত্ৰে ওষুধের সংখ্যা মাত্র বারো। বারোটা ওষুধে সর্বরোগের উপশম। লক্ষণ বিচার করে ঠিকমতো ওষুধ দিতে পারলেই হলো।
শশী ভট্টাচাৰ্য মনে হয় বান্ধবপুরে স্থায়ী হয়ে গেছেন। বান্ধবপুরে প্রাইমারি স্কুল চালু হয়েছে। তিনি তার শিক্ষক। ছাত্রসংখ্যা তিন। তাঁর প্রধান কাজ ছাত্র সংগ্ৰহ করা। অপ্রধান কাজ হরিচরণের জমিদারির হিসাব-নিকাশ দেখা।
শশী ভট্টাচার্যের বর্তমান পরিচয়- পাগলা মাস্টার।
যে মাস্টার কালো একটা চামড়ার ব্যাগ হাতে ঘুরে বেড়ায়। ছোট ছেলে।পুলে দেখলে পেছন থেকে এসে ঘাড় চেপে ধরে বলে— তোর বাবার কাছে আমাকে নিয়ে যা। ভোকে স্কুলে ভর্তি করাব। পেট এত মোটা কেন? পেটভর্তি কৃমি গজগজ করছে। হা কর— ওষুধ খাবি।
রোগী পালাতে চেষ্টা করে। ঝেড়ে দৌড় দেয়। পেছনে পেছনে দৌড়ান শশী মাস্টার।
একদিন রোগীর পেছনে ছুটতে শশী মাস্টার শশাংক পালের সামনে পড়ে গেল। শশাংক পাল বললেন, আপনার পরিচয়?
রোগী ধরার জন্যে দৌড়াচ্ছি।
ও আচ্ছা! আপনি পাগলা মাস্টার। আপনার কথা শুনেছি। আমার নাম শশাংক পাল। জমিদারি ছিল। হাতিতে চড়ে ঘুরতাম। এখন হাঁটাহাঁটি করি।
শশী মাস্টার বললেন, হাঁটাহাঁটি করা শরীরের জন্যে ভালো। ভিক্ষুক শ্রেণীর যারা সারাদিন হাঁটার মধ্যে, তারা রোগমুক্ত।
শশাংক পাল বললেন, আমি বর্তমানে ভিক্ষুক শ্রেণীতেই পড়ি, তবে রোগমুক্ত না। নানান রোগ শরীরে স্থায়ী হয়েছে। ভালো কথা, আপনি কি মদ্যপান করেন?
না।
শশাংক পাল বললেন, মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে ভালো হতো। আপনার সঙ্গে মদ্যপান করতাম। একা মধ্যপান করা বড়ই কষ্টের।
শশী মাস্টার বললেন, আপনি বোতল নিয়ে আমার এখানে চলে আসবেন। আপনি বোতল নামাবেন আমি ব্যাঞ্জো বাজাব। কলের গানের গানও শুনতে পারেন। আমার একটা কলের গানও আছে।
আপনার কলের গানের কথা শুনেছি। কলের গানের গান আমি পছন্দ করি না। যে গানে গায়ককে দেখা যায় না সেই গান মূল্যহীন। আপনার চামড়ার বাক্সে কি ওষুধ? লিভারের ব্যথার কোনো ওষুধ যদি থাকে দিন। খেয়ে দেখি। আমি আবার ওষুধ খেতে খুব পছন্দ করি। যে-কোনো ওষুধ আগ্রহ করে খাই।
বৈশাখ মাসের এক রাতের কথা। আকাশে নবমীর চাঁদ উঠেছে। শশী মাস্টারের টিনের চালে চাঁদের আলো পড়েছে। টিনের চাল ঝলমল করছে। বনভূমির ঝাঁকড়া সব গাছ মাথায় জোছনা মেখে দুলছে। সৃষ্টি হয়েছে অলৌকিক এক পরিবেশ। শশী মাস্টার কলের গান ছেড়ে জোছনা দেখতে ঘরের বার হয়ে থমকে দাঁড়ালেন। জামঘাছের নিচে টুকটুকে লালশাড়ি পরে এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে।