ধনু শেখ বাড়ি ফিরছেন। হিসাবমতো তাঁর লোকজনের কর্মকাণ্ড শুরু হবার কথা। তা হচ্ছে না, কারণ লঞ্চঘাটে নমশূদ্রদের একটা বিশাল দল লাঠি, সড়কি, রামুদা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের সঙ্গে আছেন মুনিশংকর। তাঁর নির্দেশে এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। লঞ্চের কেবিনে ধনু শেখের লোকজন বসা। তারা হতভম্ব।
মনিশংকর ধনু শেখের বাড়িতে এসেছেন। ঘরে ঢুকেছেন একা। তাঁর লোকজন সব বাইরে।,
ধনু শেখ বললেন, আমার কাছে কী চান?
মনিশংকর বললেন, কিছু চাই না। খবর কি জানেন?
কী খবর?
দেশ ভাগাভাগির সব ঠিকঠাক হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। বান্ধবপুরে বড়গাঙ বরাবর সীমানা। আপনি পড়েছেন হিন্দুস্থানে।
ধনু শেখ তাকিয়ে আছেন।
আমার বাড়িতে ব্যাটারিতে রেডিও বাজে। খবর শুনে আপনাকে বললাম। যাই, নমস্কার।
হিন্দু বাড়িতে শাঁখ বাজছে। ঘণ্টা বাজছে। বড়ই আনন্দময় সময়।
রাত অনেক। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
ফাকফকা জোছনা।
লাবুস পুকুরপাড়ে পাটির ওপর শুয়ে আছে। সে একা, আর কেউ নেই। সবাইকে সে কিছুক্ষণ আগে সরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে। আজ যেমন করছে। লাবুসের শরীর খুবই খারাপ করেছে। জুলুনি অনেক বেড়েছে। তারপরেও জোছনা দেখতে ভালো লাগছে। এই সুন্দর চাঁদের আলো সে আর বেশিদিন দেখবে না। নিস্তব্ধ রাতে ঝিঝিপোকার ডাক শুনবে না। হঠাৎ লেবু ফুলের ঘাণে শরীর মন অবশ হবে না। ভাবতেই কী অদ্ভুত লাগে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ আজ তার মা’কে দেখতে ইচ্ছা হলো।
বাবা জহির!
লাবুস চমকে তাকালো। এটা কি কোনো ভ্ৰান্তি? মন চাইছে বলে সে মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছে? সারা শরীর চাদরে ঢাকা একজন মহিলা পুসকুনির সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নামলেন।
বাবা, তোমার কী হয়েছে?
লাবুস জবাব দিল না। মহিলা বললেন, বাবা, তোমার কপালে একটু হাত রাখবি?
লাবুস বলল, রাখ।
জুলেখা লাবুসের কপাল স্পর্শ করে ফুঁপিয়ে উঠল। বাবাগো, তোমার কী হয়েছে? আমার বাবার সোনার অঙ্গ কীভাবে জ্বলে গেছে?
লাবুস বলল, মা, যন্ত্রণায় অনেকদিন ঘুমাতে পারি না। একটু ঘুম পাড়ায়ে দাও।
ছোটবেলায় গুনগুন করতে করতে জুলেখা দুষ্ট জহিরকে ঘুম পাড়াত। আশ্চৰ্য, একটা সুরও মনে আসছে না।
মীরা বারান্দায় এসেছিল। সে পুকুরঘাটের দিকে তাকাল এবং দৌড়ে ঘাটের কাছে এসে দাঁড়াল। রিনারিনে গলায় বলল, তুমি কে?
জুলেখা তাকাল।
ছোট মীরা বলল, তুমি কি আমার আর লাবুসের মা?
জুলেখা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তাঁর মাথায় সুর এসেছে— আমার দুষ্ট ঘুমায়রে। আমার ন্যাওলা ঘুমায়রে। আমার ভুটু ঘুমায়রে।
মওলানা ইদরিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে।
পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোনোখানে।
[দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত]