নদীর পানিতে চিৎ হয়ে ভাসছে শ্ৰীনাথ। নিয়ামত হোসেন কাউকে কিছু না বলে মসজিদে গেলেন। টিউবকলের পানিতে আবার অজু করলেন। ফজরের নামাজ আদায় করলেন। মসজিদে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় নামাজি কেউ নেই। ফজরের নামাজে কখনোই লোক হয় না। নামাজ শেষ করে তিনি ধনু শেখের বাড়িতে গেলেন। ঘুমন্ত ধনু শেখের ঘুম ভাঙালেন। নদীতে কী দেখে এসেছেন বললেন। বর্ণনার সময় নিয়ামত হোসেনের গলা কাপতে লাগল।
ধনু শেখ বললেন, এটা বলার জন্যে তুমি আমার ঘুম ভাঙায়েছ? শ্ৰীনাথের মৃত্যুর খবর ঘুম ভাঙায়ে আমাকে দিবার কী আছে? শ্ৰীনাথ কি আমার ভায়রা ভাই? মরছে গেছে ফুরাইছে। সবাই মারা যাবে। আমিও যাব তুমিও যাবে।
নিয়ামত হোসেন বললেন, কালরাতে শ্ৰীনাথ বাবুকে আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছ? এশার নামাজ পড়ে ফিরতেছি, হঠাৎ দেখি হাত ধরে তাকে টেনে লঞ্চে নিয়ে তুলতেছে। আপনার লোকজন তুলতেছে।
আমার লোকজনটা কে?
লঞ্চে করে এরা এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করেছে।
ধনু শেখ বললেন, তুমি কি বলতে চাও আমি শ্ৰীনাথকে খুন করায়েছি?
নিয়ামত হোসেন বললেন, জি-না।
ধনু শেখ বললেন, তাহলে আমাকে এই ঘটনা বলার মানে কী?
গোস্তাকি হয়েছে।
নিয়ামত শোন, বেশি বেশি বুঝার চেষ্টা নিবা না এবং বেশি বেশি দেখবা না। কম দেখা ভালো। কম বুঝাও ভালো।
জি আচ্ছা।
হিন্দুরা সব মুসলমান মেরে শেষ করে ফেলতেছে, এইটা জানো?
জানি না।
দাঙ্গার খবর পড়া নাই? কলিকাতায় কী হয়েছে? বিহারে কী হয়েছে? মুসলমান সব শেষ। আর এদিকে পা পিছলায়ে পানিতে পড়ে মালাউন একটা মারা গেছে, আর তুমি হয়ে গেছ বেচাইন। বুরবাক কোথাকার। যাও সামনে থেকে। একটা কথা মনে রাখবা, তুমি কিছুই দেখা নাই। বুঝেছ?
জি।
আগামীকাল জুম্মাবার না?
জি।
জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। বলতে পারবো?
পারব।
তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?
পারব।
মিনমিন কর বলতেছ। কেন? জোর গলায় বলো। গলায় জোর নাই? তুমি কি মেন্দামারা মুসলমান? শরীর তো বানায়েছ মহিষের মতো। অনেক কথা বলে ফেলেছি, এখন সামনে থেকে যাও। তুমি আমার সকালের ঘুম নষ্ট করেছ। বুরবাক কোথাকার।
নিয়ামত হোসেন ঘর থেকে বের হলেন। এখন তার লঞ্চের টিকেট ঘরে যাবার কথা, তা না করে তিনি মসজিদে গেলেন। দুরাকাত নফল নামাজ পড়লেন। কিছুক্ষণ কোরান পাঠের চেষ্টা করলেন। মন বসল না। তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে টিকেট ঘরে গেলেন।
টিকেট ঘর থেকে দেখা যায় অনেক লোকজন নদীর পাড়ে ভিড় করেছে। শ্ৰীনাথকে ডাঙ্গায় তোলা হচ্ছে। বলা হরি, হরি বল ধ্বনি উঠছে। নিয়ামত হোসেন আবার টিকেট ঘর থেকে বের হলেন। তিনি গেলেন মনিশংকরের কাছে। মাথা নিচু করে ফিসফিস করে কথা বললেন। তাঁর বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট।
মনিশংকর বললেন, কাল জুম্মার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। কী বলেন আপনি?
নিয়ামত হোসেন বললেন, এই জন্যে বাইরে থেকে লোক আসছে।
লোক কে এনেছে? ধনু শেখ?
নিয়ামত হোসেন জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর বড়ই ভয় লাগছে।
আজ জুম্মাবার।
ধনু শেখ আগে জুম্মার নামাজে আসতেন। ঠ্যাং কাটা যাবার পর আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। বসে বসে নামাজ পড়ার মানে হয় না। সবাই যেন করে তাকায়। তবে আজ তিনি জুম্মার নামাজে এসেছেন। তাঁর লোকজন কেউ আসে নি। তারা লঞ্চে অপেক্ষা করছে। তাদেরকে বলা হয়েছে জুম্মার নামাজ শেষ হবার পর তিনি যখন বাড়ি ফিরবেন তখন আসল কাজ শুরু হবে।
আজ জুম্মার নামাজে ভালো জমায়েত হয়েছে। অনেক অপরিচিত মানুষও দেখা যাচ্ছে। মাওলানা ইদরিস এসেছেন। তিনি ইমাম নিয়ামত হোসেনের পাশেই বসেছেন।
নামাজ শেষে খুতবা পাঠের পর ইমাম নিয়ামত হোসেন বললেন, হাফেজ মাওলানা ইদরিস আপনাদের কিছু বলবেন।
মাওলানা ইদরিস উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, চারদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাহাঙ্গামার খবর আসতেছে। এই বিষয়ে সামান্য কিছু বলব। আমার বেয়াদবি ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক সুরা হুজুরাত-এর তের নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বড় সাবধানী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ এর বেশি আমার আর কিছুই বলার নাই। মূল আয়াতটা আমি আপনাদের আরবিতে পাঠ করে শুনাব। তার আগে ছোট্ট একটা ঘোষণা আছে- আপনারা জানেন লাবুস খুবই অসুস্থ। তার জন্যে আমি দরুদে শেফা পাঠ শুরু করেছি। যেন আল্লাহপাক তার রোগযন্ত্রণার অবসান করেন। আপনারা তার জন্যে দোয়ায় সামিল হবেন। লাবুস তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তি দান করেছে। দানপত্রে আজই বাদ জুম্মা সে দস্তখত করবে। আপনারা সবাই সাক্ষী। তার দানপত্ৰ মতে এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে তার সবকিছু ব্যয় হবে। স্কুল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয়। আপনারা সবাই বলেন, মারহাবা। অন্তর থেকে বলেন।
সবাই মারহাবা বলল। ধনু শেখও বললেন।
এরপর দোয়া পাঠ হলো এবং ইমাম নিয়ামত হোসেন আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।