পুকুরঘাটে শীতলপাটি বিছানো। শীতলপাটির ওপর কলাপাতা। লাবুস কলাপাতার ওপর শুয়ে থাকে। তাকে সারাক্ষণ পাখা দিয়ে বাতাস করে হাদিস উদ্দিন। মাওলানা ইদরিস তার মেয়েকে নিয়ে পাশেই থাকেন। তিনি নফল রোজা রাখছেন। এবং মনে মনে কোরান খতম দিচ্ছেন।
লাবুস বেশির ভাগ সময় থাকে ঘোরের মধ্যে। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখে। অপরিচিত নানানজনের সঙ্গে কথা বলে। যেসব ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে হুবহু সেই ঘটনাও ঘটতে দেখে। একদিন দেখল পুকুরঘাটে বসে বিভূতি বাবু মুগ্ধ গলায় নিজের বই পড়ে শুনাচ্ছেন। লাবুস এবং হাদিস উদ্দিন পাঠ শুনছে। কী পড়া হচ্ছে তাও লাবুসের মনে আসে। একটি শব্দও এদিক ওদিক হয় না।
কুড়ুলে বিনোদপুরের বিখ্যাত বস্ত্রব্যবসায়ী রায় সাহেব ভরসারাম কুণ্ডুর একমাত্র কন্যার আজ বিবাহ। বরপক্ষের নিবাস কলকাতা, আজই বেলা তিনটার সময় মোটরে ও রিজার্ভ বাসে কলকাতা থেকে বর ও বরযাত্রীরা এসেছে। অমন ফুল দিয়ে সাজানো মোটরগাড়ি এদেশের লোক কখনো দেখে নি।
একদিন সে তার মা জুলেখাকে দেখল। দোতলা পাকাদালানের একটা বড় ঘরে জুলেখা সতরঞ্চির ওপর বসে। তার সামনে হারমোনিয়াম। একপাশে রূপার পানদানিতে পান। ঘরের এক কোনায় জুলেখার কাছ থেকে বেশ দূরে তবলা এবং তানপুরা নিয়ে একজন বসেছে। একজন বংশীবাদক আছে, সে বসেছে জুলেখার পাশে। জুলেখা গান করছে এবং বৃদ্ধ এক শেরওয়ানি পরা মানুষ গান শুনছেন। গানের কথা–
কেবা কার পর, কে কার আপন,
কালশয্যা পরে মোহতন্দ্ৰা ঘোরে।
দেখি পরস্পরে অসার আশার স্বপন।
হঠাৎ গান থেমে যায়। হৈচৈ-এর শব্দ শোনা যায়। একদল মানুষ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। ভাঙচুরের শব্দ। আর্তনাদ। কালো ধোয়া। লাবুসের সামনে সব অস্পষ্ট হয়ে যায়।
মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। গোল মুখ। চোখ বড় বড়। মেয়েটা সব সময় খেলছে। কখনো তার হাতে সুতা, কখনো কাপড়ের টুকরা। লাবুস তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। মেয়েটা খেলায় এতই মগ্ন থাকে যে বেশির ভাগ সময়ই লাবুসের প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
নাম কী গো তোমার?
ভুলে গেছি।
মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। তার নাম ভুলে না।
আমি ভুলে গেছি।
তুমি এই বাড়িতে থাক?
হুঁ। মাটির নিচে গুপ্তঘরে থাকি।
কতদিন ধরে থাক?
অনেক দিন। অনেক অনেক দিন। কতদিন ভুলে গেছি। আমি সব ভুলে গেছি।
তোমার বাবা মা, এদের কথা মনে আছে?
ভুলে গেছি। আমি আর কথা বলব না।
মেয়েটা উঠে চলে যায়। আবারো আসে। লাবুসের আশেপাশেই বসে খেলায় মগ্ন হয়ে যায়।
মনিশংকর বললেন, আজ শরীরটা কেমন বোধ হচ্ছে?
লাবুস বলল, ভালো।
মনিশংকর হতাশ গলায় বললেন, এই কি ভালোর নমুনা? তুমি তো মরুতে বসেছী। চলো তোমাকে কলকাতা নিয়ে যাই। বড় বড় ডাক্তাররা তোমাকে দেখুক। দেখে বলুক কী হয়েছে।
লাবুস বলল, আমার কী হয়েছে। আমি জানি। কেউ তা বিশ্বাস করবে না। জগৎ বড়ই বিচিত্র।
জগৎ বিচিত্ৰ হোক, যাই হোক, তোমার দরকার চিকিৎসা।
আমার সময় হয়ে গেছে। চিকিৎসায় কিছু হবে না।
তোমার সময় হয়ে গেছে, তুমি বুঝে ফেললা? তুমি কি ভগবান? আমি তোমাকে এইভাবে মরতে দেব না।
লাবুস বলল, আমি কাউকে যে কথা কোনোদিন বলি নাই আপনাকে বলতে চাই। মাওলানা সাহেবকে আর হাদিস উদ্দিনকে দূরে যেতে বলেন।
আমাকে বলতে চাও কেন?
আপনি বিশ্বাসী মানুষ। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন।
মাওলানা এবং হাদিস উদ্দিন উঠে গেল। হাদিস উদিনের খুব শখ ছিল ছোটকর্তার কথাগুলি শোনে। সে ছোটকৰ্তার বিষয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানে, কাউকে তা বলতে পারছে না। এখন সময় হয়েছে বলার।
লাবুস বলল, আমি চোখের সামনে অনেক কিছু দেখি। ছোটবেলা থেকে দেখতাম। তখন ভাবতাম। সবাই আমার মতো দেখে। অনেক পরে জানলাম, সবাই আমার মতো দেখে না।
কী দেখ?
ভবিষ্যতের ঘটনা দেখি। আমার মা যে আমাদের ছেড়ে খারাপ জায়গায় চলে যাবে- এটা অনেক ছোটবেলায় দেখেছি। আমি মৃত মানুষজনদের দেখি। তাদের কেউ কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে।
কী কথা বলে?
অনেক কথা। বেশির ভাগ কথার অর্থ আমি বুঝি না। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।
লাবুস হাঁপাতে লাগল। মনিশংকর বললেন, এখন আর কথা বলার প্রয়োজন নাই। বিশ্ৰাম কর।
আপনাকে অতি জরুরি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখেছি, বান্ধবপুর জায়গাটা হিন্দুস্থানের মধ্যে পড়েছে। এখানের বহু মুসলমান মারা যাবে। তাদের রক্ষার ব্যবস্থা করেন।
মনিশংকর বললেন, জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বরের সময় বিকার উপস্থিত হয়। বিকারের ঘোরে মানুষ অনেক কিছু দেখে। তোমার জ্বর কমুক। শরীর স্বাভাবিক হোক। তখন তোমার কথা শুনব।
লারুস বলল, আমার শরীর এখন জ্বলে যাচ্ছে। হাদিস উদ্দিনকে বলেন যেন শরীরে পানি ঢালে।
মনিশংকর নিজেই আজলা ভরে পানি লাবুসের শরীরে ঢালতে লাগলেন। লাবুস বিড়বিড় করে বলল, বান্ধবপুরের মহাবিপদ। অনেক মানুষ মারা যাবে। অনেক মানুষ মারা যাবে।
মনিশংকর বললেন, বাবা শান্ত হও।
মসজিদের নতুন ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রবহমান পানিতে অজু করেন। বদ্ধপানিতে অজু করার চেয়ে প্রবহমান পানিতে অজুর সোয়াব বেশি। তিনি ঘাটে বসে অজু শেষ করে উঠতে যাবেন, হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল। ভাসতে ভাসতে কী যেন এগিয়ে আসছে। ফজরের ওয়াক্ত। আকাশ এখনো অন্ধকার। পরিষ্কার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু নদীর পানি চকচক করছে। নিয়ামত হোসেন ভাসমান বস্তুটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। একসময় তিনি বিড়বিড় করে বললেন, গাফুরুর রহিম, এটা কী?