গান্ধিজি : (চুপ করে আছেন। দৃষ্টি সাগরের ঢেউয়ের দিকে)
জিন্নাহ : কংগ্রেস এখন কী করছে? মুসলিম লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে স্বীকার না করে খেলাফত আন্দোলনকে স্বীকার করছে।
গান্ধিজি : মাতৃভূমি ভাঙার দুঃখ আমি নিতে পারব না। আমি এবং আপনি কি এটা বন্ধ করতে পারি না?
জিন্নাহ : না, পারেন না। পণ্ডিত নেহেরু কিন্তু এই ভাগাভাগি চাচ্ছেন।
গান্ধিজি : আপনি ভুল করছেন। ভারত বিভক্তি কারোই কাম্য নয়। নেহেরুর তো কখনোই নয়। *
—————
* ভুল গান্ধিজি করেছিলেন। নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কংগ্রেসকে রাজি করান যেন ভারত দুটি দেশে ভাগ হয়। ভারতের নতুন ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটিন ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা শুরু করেন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় মৃত্যুর দিনরাত্রি।
এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ
বান্ধবপুর লঞ্চঘাটে এমএল আড়িয়াল খাঁ লঞ্চ ভিড়েছে। ছয়জন যাত্রী ডেকে চাদর বিছিয়ে তাস খেলতে খেলতে আসছিল। তাদের তাসখেলা শেষ হয় নি। লঞ্চ ভিড়ার অনেকক্ষণ পরেও তারা খেলা নিয়ে মত্ত রইল। যাত্রীদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে, এদের তাড়া নেই। এদের সঙ্গে মালামালও নেই। লঞ্চের কেবিন বয় বলল, আপনার নামবেন না? তাদের একজন উদাস গলায় বলল, নামতেও পারি, আবার নাও নামতে পারি।
তেমন কোনো হাসির কথা না। কিন্তু সবাই হাসছে।
কেবিন বয় বলল, যাবেন কই?
যাব দোজখে।
আবার হাসির শব্দ। এবারের হাসি আরো উচ্চকিত। তবে তার মধ্যে আনন্দ 6नश्।
ছয়জনের এই দলটি ভাড়া করে এনেছেন ধনু শেখ। এরা দাঙ্গাহাঙ্গামায় অত্যন্ত দক্ষ। তাদের সঙ্গে ধনু শেখের একটাই কথা— মালাউন কমায়ে চলে যাবে। লুটের মাল সবই তোমাদের। স্থানীয় সাহায্য যা করার তিনি করবেন। শোনা যাচ্ছে কোন জায়গা পাকিস্তানে পড়বে তা ঠিক হবে মুসলমানের সংখ্যা দিয়ে। ভোটাভুটি হবার সম্ভাবনা। বান্ধবপুরকে অবশ্যই পাকিস্তানে ঢুকাতে হবে। যে-কোনো ভালো কাজের সঙ্গে সামান্য মন্দ কাজ করতে হয়। স্বাধীন পাকিস্তান বিরাট ভালো কাজ। তার জন্যে কিছু রক্তপাত হতেই পারে। স্বাভাবিকভাবে একটা শিশুর জন্ম দিতে গিয়েও মায়েদের প্রচুর রক্ত দেখতে হয়। সেখানে নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে। সহজ কথা তো না।
ধনু শেখ খবর দিয়ে শ্ৰীনাথকে এনেছেন। মূল্য উদ্দেশ্য গল্পগুজব করা। মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা। গল্প করার সঙ্গী লাগে। ধনু শেখের প্রায়ই মনে হয়, গরু হয়ে জন্মালে ভালো ছিল। ঘাস খেয়ে জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। চিন্তা নাই, ভাবনা নাই। জগতের একমাত্র বিষয় সবুজ ঘাস। সকালক থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাস খাওয়া। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেই ঘাস জাবর কাটা। জাবর কাটার সময় মশা বিরক্ত করলে লেজের বাড়ি দিয়ে মশা মারা।
শ্ৰীনাথ, আছ কেমন?
আজ্ঞে ভালো আছি।
চারদিকে দাঙ্গা লেগে গেছে, শুনেছি বোধহয়?
শুনেছি। বান্ধবপুরে দাঙ্গা নাই, কিছু নাই, ব্যাপারটা কী বলো দেখি?
শ্ৰীনাথ বলল, আপনার মতো বিশিষ্টজনরা থাকতে দাঙ্গা কেন হবে?
ধনু শেখ বললেন, আমি বিশিষ্টজন তোমারে কে বলল? আমি অবশিষ্টজন। দুই ঠ্যাং-এর মধ্যে একটা চলে গেছে, একটা আছে অবশিষ্ট। এখন বলো আমি অবশিষ্টজন না?
শ্ৰীনাথ চুপ করে রইল। ধনু শেখ তাকে কী জন্যে ডাকিয়েছেন সে বুঝতে পারছে না। এই লোক বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করবে না।
ধনু শেখ বললেন, শুনলাম তোমরা দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি করেছ। নমশুদ্ৰ, চামার, ঢুলি সব দলে টেনেছ। রামদা সড়কির ব্যবস্থা করেছ। মুসলমান মারা শুরু করব কবে? পঞ্জিকা দেখে একটা শুভদিন বের কর। অশুভ দিনে মারামারি শুরু করলা, দেখা গেল ফল হয়েছে। খারাপ। নিজেরাই শেষ।
শ্ৰীনাথ বলল, অনুমতি দেন যাই। আমার শরীরটা ভালো না।
শরীর তো আমারও ভালো না। পচন ধরেছে। শশাংক পালের শরীর যেমন পাচে গিয়েছিল আমারও যাচ্ছে। আবার শুনলাম লাবুসের শরীরেও পচন ধরেছে। ভালো কথা মনে পড়েছে। শশাংক পালের ভূতের গল্পটা পুরা শুনা হয় নাই।
‘আমি উঠলাম’ বলে শ্ৰীনাথ উঠতে যাওয়ার আগেই ধনু শেখের লোকজন চলে এলো। ধনু শেখ বললেন, তোমরা চলে এসেছ ভালো করেছ। এর নাম শ্ৰীনাথ। আমার নিজের লোক। কাজকর্ম যা করবা এরে সাথে নিয়া করব। সে প্রত্যেক হিন্দুর বাড়ি চিনে। কোন কোন বাড়িতে ডবকা যুবতী আছে তাও জানে। কলিকাতার দাঙ্গায় বহুত মুসলমান মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে- শোধ নেয়ার প্রয়োজন আছে।
শ্ৰীনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু এইটুকু বুঝছে তার মহাবিপদ।
মুখে বসন্তের দাগওয়ালা একজন গলা নামিয়ে বলল, কাজ কি আজ রাতেই শুরু হবে?
ধনু শেখ বললেন, আরে না। বিশ্রাম কর। খাওয়াদাওয়া কর। অবস্থা বিবেচনা কর। তবে শ্ৰীনাথ যেন পালায়া না যায়। তাকে প্রয়োজন আছে।
এরা শ্ৰীনাথকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে লঞ্চঘাটের দিকে। তারা হাঁটছে দ্রুত। শ্ৰীনাথ তাদের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না। শ্ৰীনাথ বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যান?
বসন্তের দাগওয়ালা লোকটি বলল, শ্বশুরবাড়ি নিয়া যাই। তোমার শ্বশুর সাব কী করব জানো? তোমার বিচি ফালায়া তোমারে খাসি করব।
দলের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। তাদের মনে চাপা আনন্দ।
মনিশংকর লাবুসকে দেখতে এসেছেন। তিনি রোজই আসেন। অনেকক্ষণ বসে থাকেন। তাঁকে পুরাপুরি বিভ্রান্ত মনে হয়।