আমি অনুমতি দেবার কে?
আপনার আশ্রয়ে থাকব বলেই অনুমতি প্রয়োজন। গাছতলায় তো থাকতে পারি না। মাথার উপর চাল প্রয়োজন।
হরিচরণ বললেন, আমি জাতিচু্যত মানুষ। একজন ব্ৰাহ্মণ সন্তান আমার সঙ্গে থাকতে পারেন না।
শশী ভট্টাচার্য বললেন, সেটাও কথা।
হরিচরণ বললেন, আমি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেই?
তাহলে খুবই ভালো হয়। আমি নির্জনে থাকতে পছন্দ করি। জলের কাছাকাছি হলে ভালো হয়। কলিকাতায় আমাদের বসতবাড়ি গঙ্গার উপরে। জল দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে।
হরিচরণ বললেন, মাধাই খালের কাছে আমার টিনের ছোট্ট ঘর আছে, সেখানে থাকতে পারেন। একজন পাঁচকের ব্যবস্থা করে দিব।
শশী ভট্টাচাৰ্য বললেন, পাঁচক ফাচক লাগবে না। আমি নিজেই রাধব। ভালো কথা, আমি অন্যের সাহায্য বা ভিক্ষা গ্ৰহণ করি না। এই যে কয়েকদিন থাকিব তার বিনিময়ে আপনার জন্যে কী করতে পারি?
হরিচরণ বললেন, কিছুই করার প্রয়োজন নেই। আপনি অতিথি। অতিথি হলেন নারায়ণ।
সব অতিথি নারায়ণ না। কিছু অতিথি বিভীষণ। যাই হোক, আমি কর্মী মানুষ। আপনার হয়ে কাজকর্ম করে দিতে আমার কোনোই অসুবিধা নেই। শুনেছি আপনি জমিদারি কিনেছেন। আমি জমিদারির কাগজপত্র দেখে দিতে পারি। খাজনা আদায় বিলি ব্যবস্থা এইসবও করতে পারি।
আপনার পিতার কি জমিদারি আছে?
ছিল। এখন নাই। এখন তারা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। তারা থাকেন ধর্মকর্ম নিয়ে, আমি থাকি বাদ্যবাজনা নিয়ে। এই নিয়েই তাদের সঙ্গে আমার বিরোধ।
আপনি বাদ্যবাজনা করেন?
হুঁ, ব্যাঞ্জো বাজাই।
আপনার ঐ বাক্সে কি কলের গান?
ঠিক ধরেছেন। কলের গান। হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির পঞ্চাশটার মতো থােল আমার কাছে আছে।
যন্ত্রটার নাম শুনেছি, কোনোদিন দেখি নাই।
আপনার কি বাদ্যবাজনার শখ আছে?
হরিচরণ বললেন, শখ নাই।
জমিদার মানুষদের শখ থাকে। আপনে কেমন জমিদার?
হরিচরণ হাসিমুখে বললেন, আমি খারাপ জমিদার।
আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনেছি। আশা করি আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় শুভ হবে।
বাবা-মা ছেড়ে চলে আসা এই আলাভোলা ছেলেটাকে হরিচরণের অত্যন্ত পছন্দ হলো। তাঁর বারবারই মনে হলো, এই ছেলেটা যদি এখানে স্থায়ী হয়ে যেত। একটা স্কুল শুরু করা তাঁর অনেকদিনের বাসনা। ছেলেটাকে দিয়ে স্কুলের কাজ ধরা যায়। জমিদারি কাজেও মনে হয় এই ছেলে দক্ষ হবে। সমস্যা একটাই, কিছু মানুষ থাকে। কলমিশাকধর্মী। শিকড়বিহীন। কলমিশাক জলে ভাসে বলে শিকড় বসাতে পারে না। জলের উপর ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এই ছেলেটাও মনে হচ্ছে জলেভাসা।
শশী ভট্টাচার্য নিজেকে কমী মানুষ বলে পরিচয় দিয়েছিল। বাস্তবেও সেরকম দেখা গেল। অতি অল্প সময়ে হরিচরণের টিনের ঘর ভেঙে মাধ্যই খালের আরো কাছে নিয়ে গেল। এত কাছে যে বাড়ির বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলে পা খালের পানি স্পর্শ করে। ঝোপঝাড় কেটে নিয়া বসতি। কাঠের কাজ করে দিচ্ছে মিন্ত্রি সুলেমান। করাত দিয়ে কাঠ কাটতে কাটতে সে অবাক হয়ে নতুন মানুষটাকে দেখছে। নতুন মানুষটা হাত-পা নেড়ে বিড়বিড় করে কী বলে এটা তার জানার শখ। তার ধারণা যাত্ৰা থিয়েটারের কোন পাট।
শশী ভট্টাচার্য হাত-পা নেড়ে যা করে তার নাম কবিতা আবৃত্তি। গানবাজনা ছাড়াও তার কবিতা লেখার বাতিক আছে। তার লেখা কবিতা ‘উপাসনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
সুলেমান কাজ বন্ধ করে হা করে তাকিয়ে আছে। শশী ভট্টাচার্য একটা জবাগাছের দিকে তর্জনী উঠিয়ে বলছে—
সেই তুমি মুক্ত আজি জয়ধ্বনি উঠে বাজি
অমরাবতীর সভাতলে,
ছন্দে ছন্দে কানপাতি উর্বশী নাচিছে মাতি
মহেন্দ্রের লুব্ধ আঁখিজলে।
পূজার ঢাকের বাদ্য বাজতে শুরু করেছে।
তাক দুমাদুম তাক দুমাদুম শব্দে বান্ধবপুর মুখরিত। আনন্দের ছোয়া লেগেছে মুসলমানদের মধ্যেও। ছেলেপুলেরা মহানন্দে পূজাবাড়ির উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু মনে করছে না। বয়স্ক মুসলমানরা আসছে। আজ তাদেরও কেউ কিছু বলছে না।
গারোদের ধুতি পরা মনিশংকর বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যেককেই আলাদা করে বলছেন, শেখের পো’রা প্রাসাদ না নিয়া কেউ যাবে না। সাইন্ধ্যাকালে বাইজি নাচ হবে। দলে-বলে আসবা। মেয়েছেলেদের জন্যে চিকের পর্দার ব্যবস্থা प्उछ्।
পূজা নিয়ে জুলেখার সংসারে বিরাট অশান্তি শুরু হলো। জুলেখা স্বামীর কাছে বায়না ধরেছে পূজা উপলক্ষে তাকে নতুন লাল শাড়ি দিতে হবে। সুলেমান বিস্মিত হয়ে বলেছে, তোমারে শাড়ি দিব কেন? তুমি কি হিন্দু?
জুলেখা বলল, ঈদেও শাড়ি দেন নাই।
পয়সার অভাবে দিতে পারি নাই।
এখন তো পয়সা হইছে। নিয়া বারুর কাম করেছেন। এখন দেন।
সুলেমান মহাবিরক্ত হয়ে বলেছে, পূজার সময় শাড়ি দেয়া ইসলামধর্মে নিষেধ আছে। বিরাট পাপ হয়। যে শাড়ি দিবে। সে যেমন পুলসেরাত পার হইতে পারবে না, যে শাড়ি পরবে সেও পারবে না।
আপনেরে বলছে কে?
বলাবলির কিছু নাই। সবাই জানে। প্রয়োজনবোধে জুম্মাঘরের ইমাম সাবরে জিগাইতে পার।
আমার একটা মাত্র শাড়ি। ভিজা শাড়ি শরীরে শুকাইতে হয়।
সুলেমান দরাজ গলায় বলল, পূজার ঝামেলা শেষ হোক, একটা শাড়ি কিন্যা দেব।
লাল শাড়ি।
সন্তান হওনের পর লাল শাড়ি পরা নিষেধ। জিন-ভূতের নজর থাকে লাল শাড়ির দিকে। তারপরেও দেখি বিবেচনা করে।
জুলেখার লাল শাড়ির শখ অদ্ভুত উপায়ে মিটে গেল। মনিশংকর বাবু পূজা উপলক্ষে বিতরণের জন্যে একগাদা শাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। পূজার দ্বিতীয় দিনে তিনি ঝাকাভর্তি শাড়ি নিয়ে বিতরণে বের হলেন। হিন্দু মুসলমান বিবেচনায় না। এনে সবাইকে শাড়ি দিতে লাগলেন। জুলেখার বাড়ির সামনে যখন এসে দাঁড়ালেন তখন দুপুর। জুলেখা পুকুরে গোসল সেরে ভেজা শাড়িতে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। সুলেমান বাড়িতে নেই। তার ছেলেও বাড়িতে নেই। মনিশংকরকে দেখে গায়ে লেপ্টে থাকা ভেজা শাড়ির জন্যে তার লজ্জার সীমা রইল না। তার ইচ্ছা করল আবার ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়তে।