ঔপন্যাসিক লিখছিলেন—
বাতাবি লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনী ফুল নয়, রক্তপলাশ বা শিমুল নয়, কী একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগণ্য জংলি কাটা গাছের ফুল। আমার কাছে কিন্তু তাহাই কাননভরা বনভরা বসন্তের কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল।…
আপনার নাম কি বিভূতিভূষণ?
বিভূতি বাবু চমকে তাকালেন। খালের পাড়ে অতি রূপবান এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহুর্তের জন্যে তাঁর মনে এক ধরনের ভ্রান্তি উপস্থিত হলো। মনে হলো বনের দেবতা। হঠাৎ দেখা দিয়েছেন। হঠাৎ করে একজন কেউ ‘আপনার নাম কি বিভূতিভূষণ’ বলে জঙ্গলে উদয় হওয়ার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে।
আজ্ঞে আমি বিভূতিভূষণ।
আমার নাম লাবুস, আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
বিভূতি বাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি কীভাবে জানেন যে আমি খালের ভেতর নৌকা করে যাচ্ছি?
লাবুস বলল, আমি আপনাকে পেয়েছি। এটাই বড় কথা। কীভাবে পেয়েছি এটা বড় কথা না।
লাবুস নৌকায় উঠে এলো। বিভূতিভূষণ বললেন, আপনি কি আমার কোনো রচনা পড়েছেন?
লবুস বলল, না। এখানে আমরা বইপত্র পাই না। হরিচরণ বাবু প্রবাসী পত্রিকা রাখতেন। সেখানে আপনার উপন্যাসের ছোট্ট একটা অংশ পড়েছি।
নাম মনে আছে?
না। শুনেছি আপনি সুখাদ্য পছন্দ করেন। রাতে কী খেতে চান?
যা খেতে চাইব। তাই খাওয়াবেন?
অবশ্যই।
বনমোরাগের ঝোল খাওয়াতে পারবেন?
না।
মহাশোল মাছ। দোপেয়াজির মতো রান্না।
এটাও পারব না। মহাশোল পাহাড়ি মাছ, এখানে পাওয়া যায় না।
বকফুলের বড়া খাওয়াতে পারবেন?
পারব। আমার বাড়িতেই বকফুল গাছ। প্রচুর ফুল ফুটেছে।
সজনের গাছ আছে?
আছে।
সজনের ঝোল করতে বলবেন। আমার পছন্দের জিনিস।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিভূতি বাবু খাতা-কলম নিয়ে নৌকার ছাইয়ের ভেতরে চলে গেছেন। লাবুস বাইরে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। তাকে দেখাচ্ছে মূর্তির মতো। তার দৃষ্টি খালের পানির স্রোতের দিকে। একঝাক বক হঠাৎ তার মাথার ওপর দিয়ে কককক শব্দ করে উড়ে গেল। অন্য যে-কেউ চমকে বকগুলির দিকে তাকাতো। লাবুস তাকালো না।
লাবুসের বাড়িতে যে আদর এবং যত্ন লেখকের জন্যে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। রাতের খাবারের বিপুল আয়োজন। যেখানে তিনি খেতে বসেছেন তার কাছেই তোলা উনুন আনা হয়েছে। সেখানে তেল ফুটছে। বেসনে ড়ুবিয়ে বকফুল ভেজে লেখকের পাতে দেয়া হচ্ছে। বাটির পর বাটি আসছে। বিভূতি বাবু বললেন, আমার মতো অভাজনের জন্যে এত আয়োজন!
মাওলানা ইদরিস বললেন, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহপাকের জন্যে। তিনি আপনার রিজিকের এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
বিভূতি বাবু বললেন, রেঁধেছে কে?
হাদিস উদ্দিন বলল, আমি রান্না করেছি জনাব।
বিভূতি বাবু বললেন, তোমার দুটা হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা দরকার। আমার একটা উপন্যাসের নাম ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। সেই হোটেলের পাঁচক বামুন হাজারির চেয়েও তোমার রান্না ভালো।
হাদিস উদিনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। সে তার জীবনে রান্নার এরকম প্রশংসা শোনে নি। ছোটকৰ্তা লাবুস এমন মানুষ যাকে লবণ ছাড়া তরকারি রেঁধে দিলেও হাসিমুখে খেয়ে উঠবে, কিছু বলবে না। মাওলানা ইদরিসেরও একই অবস্থা, বেগুনপোড়া চটকে দিলে তাই মুখে নিয়ে বলবে–শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ।
শ্রাবণ মাসের ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বিভূতি বাবু পান মুখে দিয়ে বিছানায় শুতে গিয়েছেন। হাদিস উদ্দিন হুঙ্কা নিয়ে গেছে। তিনি হুঙ্কায় টান দিচ্ছেন। হাদিস উদ্দিন বলল, জনাব! আপনার পায়ে একটু তেল দিয়ে দেই? পরিশ্রম করে এসেছেন। আরাম পাবেন।
বিভূতি বাবু বললেন, দাও। সেবা যখন নিচ্ছি। ভালোমতোই নেই।
সকালে আপনাকে ছিটা পিঠা খাওয়াব। হাঁসের মাংস আর ছিটা পিঠা।
আচ্ছা।
হাঁসের মাংস দিয়ে ছিটা পিঠা খাওয়ার পরে আপনি বলবেন, হাদিস উদ্দিনের শুধু হাত না, তার পাও দুটাও দানা দিয়া বান্ধীয়া দাও। আচ্ছা জনাব, হাজারি বলে বাবুর্চির কথা বললেন, তার দেশের বাড়ি কই?
ওটা কল্পনার এক চরিত্র। এরকম কেউ নেই।
বিভূতি বাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, একটা মেয়ে দেখলাম, কোঁকড়া চুল, গোল মুখ, মেয়েটা কে? দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখছিল। আমি তাকাতেই চট করে সরে গেল।
হাদিস উদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, চোখে ধান্ধা দেখছেন। এই রকম মেয়ে কেউ নাই।
আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম।
হাদিস উদ্দিন বলল, আমিও আপনার মতো ধান্ধা দেখি। ছোটকৰ্তারে নিয়া একটা ধান্ধা দেখি।
কী দেখ?
পুসকুনির পড়ে উনি যখন বইসা থাকেন তখন দেখি একজন না, মানুষ দুইজন।
একই মানুষ দুজন?
জে। পেট গরম থাকলে মানুষ ধান্ধা দেখে। মনে হয় আমার পেট গরম ছিল।
শেষরাতে বৃষ্টি থেমে গেল। মেঘ কেটে চাঁদ ভেসে উঠল। বৃষ্টিধোয়া অপূর্ব জোছনা। বিভূতি বাবুর ঘুম ভেঙেছে। তিনি জোছনা দেখার জন্যে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, পুকুরের শ্বেতপাথরের ঘাটে দু’জন লাবুস বসে আছে। দু’জনই তাকিয়ে আছে দূরের বনভূমির দিকে।
একদিন থাকার জন্যে এসে তিনদিন থাকলেন। তিনবটের মাথা দেখে খুব আনন্দ পেলেন। কয়েকবার বললেন, আহারে, কী দৃশ্য! এই বলেই ভগবতগীতার একটা শ্লোক আবৃত্তি করলেন—
ন জায়তে মিয়তে বা কদাচি
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শ্বাশতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।