আতর কিছু না বলে ছুটে গেল তার স্বামীর কাছে। হড়বড় করে বলল, আমার এক দুঃখী মা এসেছেন। আপনি তাকে সমাদর করে এই বাড়িতে তুলবেন— এটা আমার অনুরোধ। শাহনেয়াজ সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। শরিফাকে কদমবুসি করে বলল, মাগো! আমি আপনার এক অধম পুত্র। মা, অতি আশ্চর্য যোগাযোগ। এই মুহুর্তে পয়ারছন্দে একটা কবিতা লিখছিলাম। কবিতার নাম ‘মাগো’। আপনি আপনার অধম কবিপুত্রের বাড়িতে বাকি জীবন থাকবেন এটা আমার আবদার।
[অপদাৰ্থ কবি শাহনেয়াজ শরিফাকে বাকি জীবন অতি আদরে নিজের বাড়িতে রেখেছে। প্রতিবার খাবার সময় নিজে উপস্থিত থেকেছে। অতি আদরে অতি যত্নে নিজে খাবার তুলে দিয়েছে। হঠাৎ করে এই মহিলার প্রতি শাহনেয়াজের এত ভক্তির কারণ স্পষ্ট না। জগৎ রহস্যময়। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।]
ইমাম করিম আতরের বাড়িতে সংসার শুরু করলেন। তার প্রধান কাজ হলো, আজান দিয়ে ভূত হাম্বরকে দূরে রাখা। তাঁর মাথা কখনোই পুরোপুরি সারে না। প্রায়ই দেখা যায় তিনি বাড়িকে ঘিরে অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চক্কর দিচ্ছেন। আতরের শ্বশুরবাড়ির সবার ধারণা, ভূত হাম্বরের কারণে ভালোমানুষ ইমাম সাহেবের এই সমস্যা হচ্ছে। হাম্বর কোনো সহজ জিনিস না। তবে ইমাম করিমও সহজ পাত্র না। বলা যায়, সমানে সমান। ইমামের আসার পর হাম্বরের উপদ্রব কিছু কমেছে। টিনের চালে তার হাঁটাহাঁটি বন্ধ হয়েছে বলেই মনে হয়।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ ঘাটশিলা থেকে বান্ধবপুর উপস্থিত হলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল বান্ধবপুরের তিনবটের মাথা পানির সময় দেখতে হয়। পানিতে অঞ্চল ড়ুবে যায়, বটের মাথা বের হয়ে থাকে। পাখিদের মেলা বসে। সবই হরিয়াল পাখি।
লঞ্চঘাটে নেমে বিভূতি বাবু ভালো ঝামেলায় পড়লেন। যার কাছে তিনি যাবেন কেউ তাকে চেনে না। নামও আগে কখনো শোনে নি। যাকে জিজ্ঞাস করেন সে-ই বলে ইন্নাস নামে কেউ এই অঞ্চলে থাকে না। মাওলানা ইদরিস নাম তিনি ভুলে গেছেন।
ইন্নাস করেন কী?
কী করেন জানি না। কলিকাতা গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি যমুনার আত্মীয়। যমুনা রায়।
মুসলমান ইন্নাস, হিন্দুর আত্মীয়? এইসব কী বলেন? উনার চেহারা কেমন?
বিভূতি বাবু চেহারার যথাসাধ্য বর্ণনা দিলেন। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবে তিনবটের মাথা নামের একটা জায়গা আছে। দূরদেশ থেকে একজন শুধুমাত্র তিনবটের মাথা দেখতে এসেছে- এটাও কারো হিসাবে মিলছে না।
আপনি আসছেন তিনবটের মাথা দেখতে?
হুঁ।
আর কিছু না? শুধু বটগাছ দেখবেন?
এর বাইরেও দেখার মতো কিছু থাকলে দেখব। শুনেছি বড় জঙ্গল আছে। বনজঙ্গল দেখতে আমার ভালো লাগে।
বর্ষাকালে বনজঙ্গল কী দেখবেন? সাপে কাটব। জোঁকে ধরবে।
বনের ভেতর দিয়ে শুনেছি। একটা বড় খাল গিয়েছে। নৌকা নিয়ে খালের ভেতর ঘুরব। খাল আছে না?
আছে। খাল আছে। নৌকাও আছে।
তাহলে সমস্যা কী?
সমস্যা কিছু নাই।
বিভূতিভূষণ বললেন, ইন্নাস সাহেবের খোঁজটা শুধু যদি বের করতে পারি।
এই নামে কেউ আমাদের অঞ্চলে নাই। কোনোদিন ছিলও না। আপনারে কেউ ধোঁকা দিয়েছে।
উনি ধোঁকা দেয়ার মানুষ না। সুফি মানুষ। দরবেশ।
আমাদের অঞ্চলে কোনো পীর দরবেশও নাই। সবই সাধারণ।
বিভূতি বাবু কী করবেন বুঝতে পারলেন না। লঞ্চে কোনো খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় নেমেছেন। সেই ক্ষুধা চরমে পৌঁছেছে। বান্ধবপুরে ভাতের হোটেল আছে, তবে হোটেলগুলি খোলে দুই হাটের দিনে। আজ হাটবার না। মুদির দোকান থেকে চিড়া এবং পাটালি গুড় কিনে খেলেন। লঞ্চে করে ফেরত যাবেন সেই উপায় নেই। ফিরতি লঞ্চ পরদিন দুপুরে। তাছাড়া এতদূর এসে তিনবটের মাথা না দেখে ফেরত যাবার অর্থ হয় না। রাত কাটাবার জন্যে একটা আশ্রয় দরকার। ধর্মশালা জাতীয় কিছু আছে কি-না খোঁজ করতে হবে। থাকার কথা না। বান্ধবপুর সম্পন্ন অঞ্চল না। অনেক খুঁজে পেতে একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল, সেখানে গুড়ের লাল চা ভাঁড়ে করে বিক্রি করে।
চায়ের দোকানির পরামর্শে বিভূতি বাবু ধনু শেখের বাংলাঘরে উপস্থিত হলেন। ধনু শেখকে তার সমস্যার কথা বললেন। ধনু শেখ বিরক্ত হয়ে বললেন, নাম ঠিকানা ছাড়া চলে আসছেন? আপনি তো বিরাট ‘বুরবাক’। করেন কী?
শিক্ষকতা করি। স্কুল মাস্টার।
বুরবাকের মতো বুদ্ধি শিক্ষকদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
রাতটা কাটাবার মতো একটা জায়গা পাওয়া গেলে বাধিত হতাম।
ধনু শেখ বললেন, রঙিলা বাড়িতে চলে যান। আরামে থাকবেন, সেবা পাবেন। সেবার প্রয়োজন সকলের। আমার এখানে রাখতে পারতাম, তা সম্ভব না। আমার কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। কুষ্ঠ রোগীর বাড়িতে থাকা ঠিক না। এখন বিদায় হন।
বিভূতি বাবু শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা করলেন। রাত কাটাবেন নৌকায়। নৌকার মাঝি চাল ফুটিয়ে ভাত রেধে দিবে। নদীর ওপর ডাল দিয়ে ভাত খেতে ভালো লাগবে।
এই নৌকা নিয়ে তিনি বিকালের মধ্যেই খালে ঢুকলেন। খাল দিয়ে নৌকা যাবে, তিনি বনভূমির সৌন্দর্য দেখবেন। তার মতে বঙ্গদেশের প্রতিটি বনভূমির চরিত্র এক হলেও প্রতিটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্য ধরতে পারার মধ্যে আনন্দ আছে। নৌকার মাঝির নাম হাশেম। হাশেম। তার আরোহীর কর্মকাণ্ডে অবাক হচ্ছে। কোনো কাজ ছাড়া একটা লোক খালে খালে ঘুরছে। বনজঙ্গল দেখার কী আছে? লোকটার হাতে খাতা-কলম। সে মাঝে-মাঝে নৌকা থামাতে বলে। নৌকা থামলেই গুটি গুটি করে কী যেন লেখে।