হেলমুট বললেন, বিমান আকাশে উড়তে পারছে না। জ্বালানি নেই। হিটলার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, জ্বালানি নেই কেন? জেনারেল গথার্ড হেইনরিচকে টেলিফোনে ধর। সে বলুক বিমানবাহিনীর জন্যে জ্বালানি কেন নেই। জেনারেল হেইনরিচকে টেলিফোনে ধরা গেল না। জেনারেল উইলহেম। মোনবিককে পাওয়া গেল।
জেনারেল মোনকি বললেন, আপনি যাতে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে পারেন তার জন্যে আমি বিশেষ ব্যবস্থায় দুটি বিমান প্ৰস্তুত রেখেছি।
হতভম্ব হিটলার বললেন, আমি পালিয়ে যাব?
জার্মান জাতিকে রক্ষার জন্যে আপনার বেঁচে থাকা জরুরি।
হিটলার কঠিন গলায় বললেন, আমাকে পালিয়ে যেতে হবে? আমাকে রক্ষা করার জন্যে অমর জেনারেলরা কোথায়?
জেনারেলের বক্তব্য শোনা গেল না, কারণ কাতুশা রকেট, যার আরেক নাম স্টালিন অরগান্স, বৃষ্টির মতো বার্লিনে আসতে শুরু করেছে।
২০ এপ্রিল হিটলারের জন্মদিন। হিটলার তাঁর বান্ধবীকে পাশে নিয়ে বাঙ্কারে বসে ছিলেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল আলফ্রেড জোডল। তিনি শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, জার্মান জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমাণ করবে। অবশ্যই আমরা বার্লিন রক্ষা করব। হিটলার শ্যাস্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিয়মমাফিক গ্লাস ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, আজ কি অন্যদিনের চেয়ে বেশি গোলাবর্ষণ হচ্ছে?
ইভা ব্ৰাউন বললেন, যুদ্ধের আলাপ কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ থাকুক। আসুন আমরা আনন্দময় কোনোকিছু নিয়ে আলাপ করি।
কেউ কোনো জবাব দিল না। হিটলার ইভা ব্ৰাউনের দিকে সামান্য ঝুকে এসে বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
ইভা ব্ৰাউন বললেন, হঠাৎ বিয়ের কথা আসছে কেন?
হিটলার বললেন, আমার ধারণা আমরা পরাজিত হতে যাচ্ছি। যদি সত্যি তাই ঘটে আমি আত্মসমৰ্পণ করব না। নিজেকে হত্যা করব। আমার মৃত্যুর পর ইতিহাসে লেখা হবে। আমার একজন রক্ষিতা ছিল, তা আমি চাই না।
হিটলার দ্বিতীয় দফায় শ্যাস্পেন নিলেন। টোস্ট করলেন তার বান্ধবীর সঙ্গে। নরম গলায় বললেন, আমার সুখ এবং দুঃখের চিরসঙ্গী ইভা ব্ৰাউন।
হিটলার এবং ইভা ব্ৰাউন মাটির অনেক গভীরে বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের বান্ধবপুরের একজন (হাদিস উদ্দিন) বাঙ্কারের মতোই একটি জায়গায় বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে। হরিচরণের মাটির নিচের গুপ্তঘর। যে ঘরে যাবার একটাই পথ, সিন্দুকের ভেতর দিয়ে। হাদিস উদ্দিনের গুপ্তঘরে সময় কাটানোর পেছনে কারণ আছে। সে নানান জিনিসপত্র গুপ্তঘরে রাখছে। এর মধ্যে রেশমি রুমালে মোড়া একান্নটা স্বর্ণমুদ্রাও আছে। হাদিস উদ্দিন যতবারই গুপ্তঘরে যায় স্বর্ণমুদ্রা গুনে দেখে। দুভাবে গুনে। প্রথমে এক থেকে একান্ন, তারপর শুরু হয় উল্টোদিকে গুনা। ৫১-৫০-৪৯-৪৮…
গুপ্তঘর সে ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। সেখানে পাটি বিছানো আছে। বালিশ আছে। কলসিভর্তি পানি আছে। মোমবাতি, দেয়াশলাই আছে। একটা টর্চাও আছে। হাদিস উদ্দিন পাটিতে শুয়ে গুনগুন করে মাঝে মধ্যে গান গায়। গান তার নিজের রচনা। সুরও তার নিজের। বদ্ধঘরের কারণে গানের শব্দ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে। হাদিস উদ্দিনের বড় ভালো লাগে।
ভরদুপুর। গুপ্তঘর অন্ধকার। পাটিতে শুয়ে হাদিস উদ্দিন নিচুগলায় গান করছে–
ও আমার সোনার মোহররে
মোহররে মোহররে মোহররে
তোর মনে দুঃখ? দুঃখ? দুঃখ?
আমার মনে সুখ।
ও আমার সোনার মোহররে
মোহররে মোহররে মোহররে…
অনেকবার করে ফিরে আসছে। হাদিস উদ্দিনের মনে হচ্ছে ‘ঘরভর্তি মানুষ একসঙ্গে ‘মোহররে’ বলে গান করছে।
এই সময় হঠাৎ করে বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দের মতো শব্দ হলো। রিনারিনে গলায় কে যেন হাসল। হাদিস উদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘর অন্ধকার, তবে সিন্দুকের খোলা ডালা দিয়ে কিছু আলো আসছে। গুপ্তঘরের ভেতরটা আবছা! আবছা চোখে আসে। হাদিস উদ্দিনের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা সে কী দেখছে? ঘরের এক কোণে দেয়ালের দিকে মুখ করে দশ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে বসে আছে। নিজের মনে খেলছে। এমন কি হতে পারে কোনো বিচিত্র উপায়ে মীরা নেমে এসেছে? না, তা কখনোই না। মেয়েটা মীরার চেয়ে অনেক বড়।
হদিস উদ্দিন বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহপাক রক্ষা কর। তুমি গরিব বান্দাকে রক্ষা করা। ইয়া রহমানু ইয়া রহিমু ইয়া মালিকু। হাদিস উদ্দিন চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করেই মনে হলো বিরাট বোকামি হয়েছে। তার মৃত্যু হবে চোখবন্ধ অবস্থায়। সে যে মারা গেছে। এই খবরটাও কেউ পাবে না। কে আসবে গুপ্তঘরে খোঁজ নিতে? হাদিস উদ্দিন চোখ মেলল। মেয়েটা এখনো আছে, তবে সে দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে। হাদিস উদ্দিন মেয়েটাকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। গোল মুখ, কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক। চোখ জ্বলজ্বল করছে।
হাদিস উদ্দিন বলল, এই। এই।
মেয়েটা ফিরেও তাকাল না। হাতে কী নিয়ে যেন খেলছে। সুতার মতো কিছু। মেয়েটার হাতে কয়েক গোছা করে চুড়িও আছে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে।
হাদিস উদ্দিন দেয়াশলাই হাতে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে দেয়াশলাই জ্বালাল। মোমবাতি ধরাল। এখন আর মেয়েটা নেই। তবে সুতাগুলি আছে। লাল নীল কিছু সুতা। হাদিস উদ্দিন গুপ্তঘর থেকে উঠে এলো। কানে ধরে প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে কখনো গুপ্তঘরে নামবে না। বিনা কারণে প্ৰাণ দিয়ে লাভ কী?