ধনু শেখ বললেন, উত্তমের আমি গুষ্ঠি কিলাই।
প্রচুর মদ্যপান করে তিনি ঘুমুতে গেলেন। বিকট স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভাঙল। স্বপ্নে তিনি একজন কুষ্ঠরোগী। ভিক্ষা করছেন কোলকাতা রেলস্টেশনে। তাঁর শরীরের মাংস গলে গলে পড়ছে। মাছি চারদিকে ভিনভন্ন করছে। তাঁর গা থেকে খসে পড়া মাংস একটা মোটা তাজা কুকুর খাপ খপ করে খাচ্ছে। কুকুরটা এবার সরাসরি গা থেকে মাংস ছিড়ে নিতে এগিয়ে এলো। ভয়ঙ্কর দাঁত নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। ‘বাঁচাও বঁচাও’ বলে তিনি চিৎকার করছেন। সবাই তার চিৎকার শুনছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। বরং তারা মজা পাচ্ছে।
ধনু শেখের চিৎকার শুনে শরিফা ঘরে ঢুকল। সে রঙিলাবাড়িতে ফিরে যায় নি। পাশের কামরায় পাটি পেতে শুয়েছিল। শরিফা বলল, আপনার কী হয়েছে? বোবায় ধরেছে?
ধনু শেখ বললেন, বোঝায় ধরে নাই। কুত্তায় ধরেছে।
শরিফা বলল, মেয়েরে খবর দিয়া নিয়া আসেন। যে অসুখ আপনি বাধায়েছেন। আপনার ভালো সেবা দরকার।
চুপ। সতীশ কবিরাজ দেখে গেছে। সে বলেছে কিছু হয় নাই।
কলিকাতা শহরে যান। বড় ডাক্তার দেখান।
চুপ বললাম। চুপ।
আমি পাশের ঘরেই আছি। আবার যদি কুত্তায় ধরে ডাক দিয়েন।
ধনু শেখ ঘুমুতে গেলেন না। ভোর হওয়া পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন। নিজে আরো একবার সুচের পরীক্ষাটা করলেন। সূচ ফুটালেন এবং প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন। না, অবশ্যই তার কুষ্ঠরোগ হয় নি। তারপরেও কোলকাতার বড় ডাক্তারকে দেখাতে তো অসুবিধা নাই। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, দু’একদিনের মধ্যে কোলকাতা যাবেন। প্রয়োজনে ডাক্তার বিধানচন্দ্রের কাছে যাবেন।
ডাক্তারের নাম কার্তিক বসু। ক্যাম্মেল হাসপাতালের চর্মরোগের অধ্যাপক। তিনি ধনু শেখকে যত্ন করে দেখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এলাৰ্জিাঘটিত ব্যাধি।
ধনু শেখ বললেন, কুষ্ঠ না তো? আমার তো মনে হচ্ছে কুষ্ঠ।
কাৰ্তিক বসু বললেন, আপনার মনে হলে তো হবে না। আমার মনে হতে হবে।
সুঁচ ফুটানোর পরীক্ষা করবেন না?
সুঁচ ফুটানোর কী পরীক্ষা?
সুচ ফুটালে ব্যথা পাই কি না।
আপনি আগে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছেন তার কাছেই যান। আমার যা বলার বলে দিয়েছি।
ধনু শেখ বললেন, এলাৰ্জি হয়েছে বলেছেন, ঠিক আছে মানলাম। এলাৰ্জির চিকিৎসা করুন।
এলাৰ্জির কোনো চিকিৎসা নেই।
তার মানে কী? এটা কী বললেন?
পৃথিবীর অনেক ব্যাধি আছে যার চিকিৎসা নেই। অবাক হবার কিছু নেই।
ধনু শেখ বললেন, আমি আপনার সব কথাই মানলাম। বুঝলাম যে আমার কুষ্ঠ হয় নাই। তারপরেও আমি যদি কুষ্ঠরোগের ওষুধ খাই তাতে অসুবিধা আছে? আমাকে কুষ্ঠরোগের ওষুধ দিন।
কাৰ্তিক বসু উঠে পড়লেন। এই রোগীর পেছনে সময় নষ্ট করার অর্থ হয় না।
ধনু শেখের চুলকানি অসুখ খুবই বাড়ল। বরফ ঘষলে কম থাকে। বরফ ঘষা বন্ধ করলেই অসহ্য চুলকানি। তিনি একজন লোক রেখেছিলেন, যার একমাত্র কাজ চিরুনি দিয়ে তার গায়ে আঁচড়ানো। মাঝে মাঝে বরফ ঘষা।
তাঁর রাতের ঘুম একেবারেই কমে গেল। চোখে ঘুম আসামাত্ৰাই বিকট দুঃস্বপ্ন। এর মধ্যে একটা দুঃস্বপ্ন ভয়ঙ্কর। যেন তার একটা পায়ে দড়ি বেঁধে লঞ্চঘাটের কাছে লম্বা বকুল গাছের ডালে বুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর গা থেকে মাংস গলে গলে পড়ছে। বিকট দুৰ্গন্ধ। লঞ্চ থেকে যাত্রীরা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে নামছে এবং সবাই তার গায়ে থুথু দিচ্ছে।
ধনু শেখ স্বপ্নটা যখন দেখছেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে। হিটলারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইটালির সর্বেসর্ব বেনিতো মুসোলিনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে এবং তার বান্ধবীকে গুলি করে হত্যার পর পায়ে দড়ি বেঁধে লরেটা স্কয়ারে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে ইটালির মানুষ এদের গায়ে থুথু দিতে পারে। *
————-
* অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি– ১৯৩০ সনের দিকে ইউরোপ ভ্রমণের সময় বেনিতো মুসোলিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা হয়। মুসোলিনীর লেখা উপন্যাস ‘দ্য কার্ডিনালস মিসট্রেস’ (ইংরেজি অনুবাদ) পড়েও খুশি হন। মুসোলিনীর আতিথেয়তা এবং ভদ্রতায় রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হন। মুসোলিনী বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সাহায্যও করেন। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেন, মুসোলিনী একজন অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক এবং আঁর অতি পছন্দের। বড় মানুষদের ভুলগুলিও সাধারণত বড় হয়ে থাকে।
১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস
১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস। রুশ সৈন্যরা এগিয়ে আসছে বার্লিনের দিকে। তাদের দলপতি মার্শাল জর্জি ঝুকভ’। তার প্রধান দুই সহকারীর একজন জেনারেল আইভান কোনোভ। অন্যজন জেনারেল ভাসিল চুইকভ। তাদের সৈন্যসংখ্যা ২৫ লাখ। ট্রাকের ওপর বসানো কাতুশা রকেটের সংখ্যা ৩ হাজার ২৫৫, ট্যাংকের ংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। দূরপাল্লার কামান আছে ৪১ হাজার। বুকভের বাহিনীকে সাহায্যকারী বিমানের সংখ্যা ৭ হাজার। চলে এসেছে বার্লিনের কাছাকাছি। এরা যে-কোনো সময় বার্লিনে ঢুকে পড়বে। তাদের দূরপাল্লার কামানের আওয়াজ বার্লিনবাসী সারাক্ষণ শুনছে। হিটলার নিজেও শুনছেন। তিনি সেই শব্দ শুনতে শুনতে বললেন, যে-কোনো মূল্যে বার্লিন রক্ষা করতে হবে। রুশরা বার্লিনে ঢুকে পড়লে একদিক দিয়ে ভালো হবে, ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা এটা পছন্দ করবে না। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করবে।
রাজধানীর কমান্ডান্ট মেজর জেনারেল হেলমুট রোম্যান। তিনি হিটলারের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছিলেন। হিটলার বললেন, আমার বিমানবাহিনী কোথায়?