বান্ধবপুরের শিশুরা ইমাম করিমকে দেখামাত্র ঢিল ছুড়ছে। এককড়িকে কিছু বলছে না।
সন্ধ্যার পরও খোঁড়াখুঁড়ি চলতে লাগল। এককড়ি আরো দু’জন কমলা নিয়ে এসেছে। রাতচুক্তি কামলা। সারারাত কাজ করবে। সূর্য ওঠার পর মজুরি নিয়ে বিদায় হবে। একটা হ্যাজাক লাইট জোগাড় করা হয়েছে। হ্যাজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। কেমন উৎসব উৎসব ভাব।
রঙিলা বাড়ি থেকে পালকি যাচ্ছে ধনু শেখের বাড়িতে। চার বেহারার পালকি। সঙ্গে একজন চরণদার। পালকিতে শরিফা। অনেকদিন পর আজ তার ডাক পড়েছে।
পালকি হ্যাজাক বাতির কাছে আসতেই শরিফা বলল, থামেন।
পালকি থামল।
শরিফা চরণদারকে বলল, ইমাম করিম সাহেবরে একটু কাছে আসতে বলেন। আমি তারে দুইটা কথা বলতে চাই।
এককড়ি বললেন, পালকিতে কে যায়?
চরণদার বলল, রঙিলা বাড়ির কইন্যা যায়।
খাড়াইলা কেন? কাজের মধ্যে ঝামেলা। চইল্যা যাও।
চরণদার বলল, সামান্য কাজ আছে। কাজ শেষ হলে চলে যাব।
সে করিমের কাছে গেল। করিম কোনো আপত্তি ছাড়াই পালকির পাশে এসে দাঁড়াল।
শরিফা বলল, ভালো আছেন?
করিম বলল, ভালো আছি।
শরিফা বলল, আপনি আমারে দেখতে পাইতেছেন না। আমি দেখতেছি। আপনার শরীর ভালো না। লোকে বলে আপনার না-কি মাথাও নষ্ট হয়েছে।
হুঁ।
আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
হুঁ।
বলেন, আমি কে?
তুমি শরিফ।
এখন আমি শরিফা না। আমি রঙিলা বাড়ির নটি। আমার নাম–ফুলকুমারী। নাম সুন্দর না?
হুঁ।
এককড়ি ধমক দিল, কাজকাম ফালায়া কী শুরু করলা?
করিম কোদাল হাতে নেমে গেল। শরিফার পালকিও চলতে শুরু করল। বেহারারা হুম হাম শব্দ করছে। তারা নিঃশব্দ হলে শরিফার কান্নার শব্দ শুনতে পেল।
ধনু শেখের শরীর খারাপ করেছে। মাথায় যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব। শরীরে চুলকানিও হয়েছে। কিছুক্ষণ চুলকালেই জায়গাটা ফুলে। লাল হয়ে যাচ্ছে। সতীশ কবিরাজ সন্ধ্যাবেলা এসে দেখে গেছে। তার কথামতো চুন এবং নিমপাতা বাটা লাগানো হচ্ছে। বমিভাব কাটানোর জন্যে গন্ধভাদালির বড়া খেয়েছেন। এতে বমিভাব আরো বেড়েছে। বমি হয়ে গেলে শরীর ভালো লাগবে- এই ভেবে গলায় আঙুল দিয়ে বমির চেষ্টাও করেছেন। বমি হয় নি। মনে হচ্ছে একগাদা খাবার গলার কাছে আটকে আছে।
শরীরের এই অবস্থায় কোনো কিছুই ভালো লাগে না। শরিফাকে তিনি বললেন, যাও চলে যাও। ভাগো।
শরিফা বলল, কোথায় যাব?
যেখান থেকে আসছ সেখানে যাবে। আমার শরীর ভালো না।
শরীরে কী হয়েছে?
চুলকানি হয়েছে।
শরিফা আগ্রহ নিয়ে বলল, দেখি?
ধনু শেখ বললেন, কী দেখবা? তুমি কি ডাক্তার কবিরাজ?
শরিফা বলল, আপনার কুষ্ঠরোগ হয়েছে কি-না এইটা দেখব। আপনার কুষ্ঠরোগ হওনের কথা।
ধনু শেখ থমথমে গলায় বললেন, কী বললা?
শরিফা স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি অন্তর থেকে অনেকবার বলেছি আপনার যেন কুষ্ঠ হয়। অন্তর থেকে যে যা চায় তাই হয়।
ধনু শেখ বললেন, তুমি তো অন্তর থেকে তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চেয়েছিলে। যেতে পেরেছ?
শরিফা বলল, অন্তর থেকে তখন চাই নাই। এখন চাই।
তোমার ধারণা ইমাম করিম তোমার মতো এক নটিকে বিবাহ করে সংসার শুরু করবে?
হুঁ।
ধনু শেখ বললেন, সে ইচ্ছা করলেও তো পারবে না। আমি তোমারে এখনো তালাক দেই নাই।
শরিফা বলল, আমি এখনো আপনার স্ত্রী?
অবশ্যই।
তাহলে আমি আর রঙিলাবাড়িতে যাব না। এইখানেই থাকব। আপনার লোকজনদের বলেন গরম পানি করতে, আমি সিনান করব।
ধনু শেখ বললেন, তুমি এক্ষণ বিদায় হবা।
শরিফা বলল, অবশ্যই না। আমি আপনার স্ত্রী।
বলতে বলতে শরিফা শব্দ করে হাসল। ধনু শেখ বললেন, হাসো কেন?
শরিফা বলল, আমি আপনার স্ত্রী। থাকি রঙিলাবাড়িতে। একদিন মনে করেন আপনার মেয়েজামাই আমোদ ফুর্তি করতে রঙিলাবাড়িতে উপস্থিত। তার আবার মনে ধরল আমারে… হি হি হি।
ধনু শেখ বললেন, চুপ কর মাগি!
শরিফা বলল, ভালো বুদ্ধি দেই শুনেন। আমারে তালাক দিয়া নিজের ইজ্জত রক্ষা করেন।
ধনু শেখ বললেন, তালাক তালাক তালাক। এখন তুই বিদায় হ। শরিফা বলল, আজ আর যাব না।
তোরে লাত্থায়া বিদায় করব।
শরিফা বলল, এইটা পারবেন না। একটা মোটে ঠ্যাং। এক ঠ্যাং-এ লাথালাথি করা যায় না। আচ্ছা শুনেন, আপনার পায়ের পাতা কি চুলকায়? কুষ্ঠরোগের আরেক লক্ষণ পায়ের পাতা চুলকানি।
রাত অনেক হয়েছে। তারপরেও ঘুম থেকে তুলে সতীশ কবিরাজকে আনা হয়েছে ধনু শেখের কাছে।
ধনু শেখ বললেন, ঠিকমতো বলো। আমার কি কুষ্ঠ হয়েছে?
সতীশ কবিরাজ বললেন, কুষ্ঠ কেন হবে?
ধনু শেখ বললেন, কেন হবে, কেন হবে না এই বিবেচনা পরে। আগে দেখ হয়েছে কি-না।
না।
ধনু শেখ বিরক্ত গলায় বললেন, না দেইখাই বললা— না। আগে দেখ।
সতীশ কবিরাজ বললেন, কুষ্ঠ যে জায়গায় হবে সেই জায়গা অসাড় হয়ে যাবে। সূচ ফুটালে ব্যথা লাগবে না।
সুচ ফুটায়া দেখ। তার প্রয়োজন নাই।
ধনু শেখ বিরক্ত মুখে বললেন, প্রয়োজন আছে কি নাই সেই বাহাস পরে করবা, আগে সুচ ফুটাও।
সতীশ কবিরাজ সূচ ফুটালেন। ধনু শেখ ব্যথায় বিকট চিৎকার দিলেন। সতীশ কবিরাজ বললেন, নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান। আপনার যকৃত দুষ্ট হয়েছে। যকৃত দুষ্ট হলে চুলকানি হয়। সকালে ওষুধ দিব। অনুপান দিয়ে দিব। নিয়মিত খাবেন। ওষুধ যে কদিন খাবেন সেই কদিন মদ্যপান করবেন না।
আজ তো খেতে পারব? ওষুধ তো শুরু হয় নাই।
সতীশ কবিরাজ বললেন, নিয়ম রক্ষার জন্যে সামান্য চলতে পারে। তবে না খাওয়াই উত্তম।