ধনু শেখ ডেকে পাঠিয়েছেন মাওলানা ইদরিসকে। তিনি জুম্মাঘর তৈরি করে দিয়েছেন। জুম্মাঘরের দায়িত্ব মাওলানাকে দিতে চাচ্ছেন। ইমাম করিমকে দায়িত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে এখন জুটেছে এককড়ির সঙ্গে। কোদাল নিয়ে সে এককড়ির সঙ্গে আছে। এককড়ি কোনো জায়গা দেখিয়ে দেয়া মাত্র কোদান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
ধনু শেখ বললেন, মাওলানা, আপনার খবর কী?
জি জনাব। আমার খবর ভালো।
লোকে আপনাকে ডাকে কাউয়া মাওলানা। শুনলাম। আপনার এখন একমাত্র কাজ কাউয়া আঁকা। ঘটনা কী?
ইদরিস জবাব দিলেন না। ধনু শেখ বললেন, কাউয়া কেন আঁকেন?
জনাব, মেয়েটারে খুশি করার জন্যে আঁকি।
কাউয়া একটা বদপাখি। ময়লা খায়। দেখতে অসুন্দর। তার ডাক অসুন্দরকা কা কা। তারে আঁকার দরকার কী? দুনিয়াতে সুন্দর পাখির কি অভাব আছে? ময়ুর আছে, টিয়া আছে, কাকাতুয়া আছে। আছে কিনা বলেন?
জি জনাব আছে।
হাঁস মুরগিও তো সুন্দর। এদের মাংসও খাওয়া যায়। হাঁস মুরগিও তো আঁকতে পারেন।
ইদরিস চুপ করে আছেন। ধনু শেখের নির্দেশে সদরুল মাওলানার সামনে কাজল এবং পেনসিল রাখল। ধনু শেখ বললেন, দেখি একটা কাউয়া আঁকেন। সবাই আপনার কাউয়া আঁকা দেখেছে, আমি দেখি নাই। তাড়াতাড়ি আঁকেন। আমার হাতে সময় নাই।
মাওলানা আঁকলেন। ধনু শেখ বললেন, খারাপ না। দেখি এখন একটা মুরগি আঁকেন।
মাওলানা আঁকলেন।
মুরগির সাথে কয়েকটা বাচ্চা দিয়ে দেন। মায়ের পিছনে পিছনে বাচ্চা ঘুরছে।
মাওলানা আদেশ পালন করলেন।
ধনু শেখ বললেন, কার ভেতরে কী গুণ থাকে। কেউ জানে না। আপনার ভিতরে যে এই গুণ ছিল কে ভেবেছে। যাই হোক, জুম্মাঘরের ইমামতি শুরু করেন। আইজ থাইকা শুরু। আছর ওয়াক্তে আজান দিয়া শুরু করেন।
মাওলানা বললেন, আমি বিরাট পাপী মানুষ। একজন পাপী মানুষ মসজিদের ইমাম হইতে পারে না। আমি প্রতিদিন পাপ করি। অবস্থা এমন হয়েছে যে পাপ ছাড়া থাকতে পারি না। আজকেও পাপ করেছি।
কী পাপ করেছেন?
ছবি এঁকেছি।
এটা কি পাপ?
জি জনাব পাপ।
তাওবা করেন। তওবা করলেই তো পাপ শেষ। পাপ করবেন, তারপর আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে পাপমুক্ত হবেন, আবার পাপ করবেন।
মাওলানা বললেন, এটা আল্লাহপাককে ফাঁকি দেওয়া। এই কাজ আমি করব না।
মসজিদের ইমামতি তাহলে করবেন না?
জি-না জনাব।
আপনি তো বেয়াদবও আছেন। আমার মুখের উপর ‘না’ বলা বিরাট বেয়াদবি।
আল্লাহপাকের কোনো হুকুমে না বলা বেয়াদবি এবং মহাগুনাহর কাজ। আপনাকে না বলা বেয়াদবি না। তারপরেও না’ বলায় যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন। আমি ক্ষমা চাই। মানুষের মনে কষ্ট দেয়া নিষেধ আছে।
ধনু শেখ বললেন, আপনি আমার সামনে থেকে যান। কাউয়াদের কাছে যান। তাদেরকে নিয়া কা কা করেন।
ইদরিস বের হয়ে এলেন। আসরের নামাজের পর বড়গাঙের পাড়ে বসলেন। হাতে কাগজ এবং পেনসিল। আজ তিনি গাছের ছবি আঁকবেন। গাছের ছবি আকাতে কোনো পাপ নেই। গাছ তো আর জীবজন্তু না। সন্ধ্যা নাগাদ ছবি শেষ হলো। প্রাণ, স্বাস্থ্যু এবং সৌন্দর্যে ঝলমলে একটা লেবুগাছ। লেবু। ফলে আছে। লেবু ফুল ফুটে আছে। ছবির দিকে তাকালে লেবু ফুলের গন্ধ নাকে লাগে।
মাওলানা বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। গাঙের পাড়েই মাগরেবের নামাজ শেষ করেছেন। নামাজে পুরোপুরি মন দিতে পারেন নি। দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। সন্ধ্যার আকাশের কী সুন্দর রঙ। পেনসিল দিয়ে এই রঙ আনা যাবে না। রঙ তিনি পাবেন কোথায়? কাঁচাহিলুদের রস থেকে হলুদ রঙ পাওয়া যাবে। সেগুন গাছের কাঁচিপাতা বাটা থেকে লাল রঙ। নীল পাবেন কোথায়? সাদা কাপড়ে যে ‘নীল’ দেয়া হয় সেই নীল কি ব্যবহার করা যায়? আকাশে আছে সাদা মেঘের স্তুপ; সাদা রঙ হিসেবে চকখড়ি কেমন হবে?
মাওলানা সাহেব, আদাব।
ইদরিস চমকে তাকালেন। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলেন বলেই হঠাৎ মনে হয়েছে আকাশ থেকে কেউ একজন বলেছে, আদাব।
আদাব বলেছেন এককড়ি। তিনি উবু হয়ে সড়কে বসে আছেন। সড়কের পাশেই গর্ত করা হচ্ছে গর্ত করছে ইমাম করিম। ঠাকুর স্বপ্নে এককড়কে দেখা দিয়ে বলছেন, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বরাবর গর্ত করে যেতে। রাস্তার পাশেই আছে। ঠিক কোথায় তা বলা যাচ্ছে না।
ইদারস বললেন, ভালো আছেন?
এককড়ি বললেন, সামান্য পেরেশানির মধ্যে আছি। তবে আজ পেরেশানির অবসান হবে। কলসি পাওয়া যাবে। আজ দিন শুভ। শুক্লা পঞ্চমী।
ইমাম করিম ঝাপঝাপ কোদালের কোপ দিচ্ছে। তার সারা গা দিয়ে ঘাম পড়ছে।
টং করে শব্দ হলো। এককড়ি চেচিয়ে উঠলেন, আস্তে আস্তে। কলসি যেন না ভাঙে।
কলসি না। ইটের টুকরায় কোদালের কোপ পড়েছে এককড়ি তাতে হতাশ হলেন না। হতাশ নামের মানবিক বিষয়টি পাগলদের মধ্যে অনুপস্থিত। তারা বাস করে সম্পূর্ণ হতাশামুক্ত জগতে।
ইমাম করিম বলল, মাওলানা ঘরে যান। আমাদের কাজের অসুবিধা হইতেছে। দাঁড়ায়া দেখার কিছু নাই। জিনিস যখন পাব সবেই জানবেন। আমাদের মধ্যে লুকাছাপা কিছু নাই।
মাওলানা বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তাঁর মন বিষণ্ণ। তিনি খবর পেয়েছেন করিমের পাগলামি অনেক বেড়েছে! এখন সে রেগে গেলেই কোদাল নিয়ে তাড়া করে। দূরের কোনো শহর বন্দ্রে ছেড়ে দিয়ে আসা আসা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবার ধারণা করিমের মাথার যে অবস্থা দূরে ছেড়ে দিয়ে এলে সে পথ চিনে আসতে পারবে না।
অঞ্চলে একজন পাগল থাকা ভালো। এতে অঞ্চলের ‘বরকত’ হয়। কিন্তু বিপদজনক পাগল থাকা ভালো না। এরা কখন কী করবে। তার ঠিক নেই। ইমাম করিম বিপদজনক পাগলের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কে বিপদজনক পাগল কে না। তা ঠিক করে অঞ্চলের শিশুরা। তারা যখন কোনো পাগল দেখামাত্র বিপুল উৎসাহে তার দিকে ঢ়িল ছুড়তে শুরু করে তখন ধরেই নিতে হবে সে বিপদজনক পাগল।