ভাঙা হাঁড়ি, মাটির ঢাকনি জাতীয় জিনিস উঠে আসছে। আসল জিনিস এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অস্থির হবার কিছু নাই। ধৈর্য ধরতে হবে।
খোঁড়াখুঁড়ি দেখার জন্যে অনেকেই জড়ো হয়েছে। গুপ্তধন খোঁজা হচ্ছে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটায় এককড়ি খুবই বিরক্ত। তিনি ধমকাধমকিও করেছেন- লাভ হচ্ছে না।
রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এবং খোড়াখুঁড়ির উত্তেজনায় দুপুরের দিকে এককড়ির ঝিমুনির মতো হলো। এই ঝিমুনির মধ্যেই তিনি ঠাকুরকে স্বপ্নে দেখলেন। ঠাকুরকে লজ্জিত এবং দুঃখিত দেখাচ্ছিল।
এককড়ি! ছোট্ট ভুল হয়েছে রে।
কী ভুল?
জায়গা ভুল। গুপ্তধন পোতা আছে। পুরনো কালীবাড়িতে, এখানে না।
কালীবাড়ির কোন জায়গায়?
যেখানে বলি দেয়া হয় ঠিক তার নিচে। হাঁড়িকাঠির নিচে। বেশি খুঁড়তে হবে। না। ছয় সাত হাত।
মোহর কয়টা আছে জানেন?
না। তবে বাদশাহি মোহর।
কোন বাদশাহ? বাদশাহ জাহাঙ্গীর?
হুঁ। বাদশাহ জাহাঙ্গীর। আসল গিনি সোনার মোহর।
হাঁড়িটা কত বড় সেটা বলেন।
হাঁড়ি না। কলসি। মাঝারি সাইজের কলসি।
এককড়ি হুড়মুড় করে উঠে বসলেন। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
জিনিসটা কোথায় পুতেছিলাম ভুলে গেছি, এখন মনে পড়েছে। চলে যাচ্ছি, তবে তুমি নিশ্চিত থাক— তোমাকে একটা মোহর দিব। তোমার জায়গায় হলে দুটাই দিতাম।
লাবুস বলল, আমার মনে হচ্ছে। আপনার শরীরটা খারাপ। আপনি গোসল করে খাওয়াদাওয়া করুন। বিশ্রাম করুন।
জিনিসটা বাড়িতে নিয়া তারপর স্নান করে খাওয়াদাওয়া করব। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কার মোহর। এখন দর হবে তিনশ’ টাকার উপর। হবে না?
জানি না, হতে পারে।
আচ্ছা আমি যাই। আমি কাজ শেষ করে কমলা দুটাকে পাঠায়ে দিব। এরা গর্ত বন্ধ করে দিয়ে যাবে।
এককড়ি হস্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নাই। কালীবাড়ির হাঁড়িকাঠের নিচটা খুঁড়ে সাত-আট ফুট গর্ত করা হয়েছে। ভাঙা ইট এবং ভাঙা কলসি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় নি। সন্ধ্যাবেলা প্রবল জ্বর নিয়ে এককড়ি ফিরলেন। তাঁর দৃষ্টি এলোমেলো। চোখ রক্তবর্ণ। হাঁপানির টান উঠেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তারপরেও ফুসফুস ভরাতে পারছেন না।
জ্বর এসেছে মাওলানা ইদরিসেরও। বেশ ভালো জ্বর। তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই জ্বরজারি হচ্ছে। শরীর ভেঙে পড়েছে বলে তিনি অল্পতেই কাহিল হয়ে পড়েছেন। এই কাহিল অবস্থাতেও তাকে ছবি আঁকতে বসতে হয়েছে। মীরা মানছে না।
কাকের ছবি হলে কোনো সমস্যা ছিল না। দুটা টান দিয়েই তিনি কাক আঁকতে পারেন। মীরা বলছে কাক আঁকলে হবে না, মীরাকে আঁকতে হবে। মানুষের ছবি আঁকা গুনাহর কাজ। আল্লাহপাক অপছন্দ করবেন। বাম কাঁধে বসে থাকা ফেরেশতা বদি লিখবো। কিন্তু তিনি মীরাকে মানাতে পারছেন না। সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বসে আছে।
মীরা শান্তভঙ্গিতে কোলে হাত রেখে বসে আছে। ইদরিস মীরার সামনে বসেছেন। ছবি আঁকার কাগজ মেঝেতে বিছানো। কাক আঁকা আর মানুষ আঁকা তো এক না। শুরু করবেন। কোথেকে? চোখ থেকে শুরু করবেন। প্ৰথমে বাম চোখ। হিসাব করে ডান চোখ। তারপর ঠোঁট।
মাওলানা কয়লা হাতে নিয়ে বললেন, বিসমিল্লাহ। বলেই মনটা খারাপ হলো, একটা নিষিদ্ধ কাজ তিনি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে যাচ্ছেন! ভুলের উপর ভুল।
মীরা বলল, বাবা, শুরু কর।
ইদরিস তার কন্যার বা চোখের মণির কালো অংশ এঁকে ফেললেন। এই চোখ চকচক করছে। চকচকে ভাবটা আনতে হবে। চোখের মণির কালো এখান থেকে একরকম লাগছে না। কোথাও বেশি কোথাও কম। চোখের মণি ঠিক করতে করতেই ডান চোখের মণির জায়গাটা একটা বিন্দু এঁকে ঠিক করলেন। তারপর ঠোঁটের জায়গাটা ঠিক করা হলো। এখন তাঁর মূল কাজ হচ্ছে, একটা চোখ আঁকতে আঁকতে মুখের অবয়বের জায়গাগুলি ঠিক করা।
মাওলানা আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। তার সামনে এখন মীরা ছাড়া কিছু নেই। মীরা কয়েকবার ডাকল, বাবা! বাবা! মাওলানা জবাব দিলেন r
ঠোঁট আঁকা হয়েছে। ঠোঁট হয়েছে হাসি হাসি। এটা তো ঠিক না, মীরার ঠোঁটে কান্নাভাব প্রবল। হাসিকে কান্নায় নিয়ে আসতে হলে কী করতে হয় তা তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি যে জানেন না এটাও ঠিক না। তাঁর মাথার ভেতরে কেউ একজন বসে আছে। সে জানে। সে অবশ্যই জানে।
আঁকা শেষ করে মাওলানা ছবিটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আহারে, কী সুন্দর হয়েছে ছবিটা! একটা অবাক শিশু অভিমানে ঠোঁট বঁকিয়ে বসে আছে। তার চোখে পানি নেই, কিন্তু চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি কাঁদবে।
মীরা বলল, বাবা, কাঁদছ কেন? ছবিটা তো সুন্দর।
এই জন্যেই কাঁদছি রে মা।
মাওলানা অজু করে নামাজ পড়তে বসলেন। ‘তাওবা ওস্তাগাঁফেরুল্লাহ’ বলে আল্লাহপাকের কাছে অন্যায়। এই কাজের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। একটা অবোধ শিশুর মনতুষ্টির জন্যে এত বড় একটা অন্যায় কাজ তাকে করতে হয়েছে।
হাদিস উদ্দিন মীরার ছবি নিয়ে গেল লাবুসের কাছে। লাবুস, হতভম্ব হয়ে বলল, একী!
হাদিস উদ্দিন বলল, মওলানা সাব এঁকেছেন।
লাবুস বলল, কী অবিশ্বাস্য কথা!
হাদিস উদ্দিন বলল, আমি ভাবছিলাম উনি কাউয়া ছাড়া কিছুই আঁকতে পারেন না। এখন দেখলেন অবস্থা!
লাবুস বলল, আমি এত সুন্দর এত জীবন্ত ছবি কোনোদিন দেখি নাই। দেখে কি মনে হয় জানো? ডাকলে মীরা উত্তর দিবে।
লাবুস সত্যি সত্যি ছবির দিকে তাকিয়ে ডাকল, মীরা। মীরা। এই পুষ্পরানি।