এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কেন মসজিদ ঠিক করে দেব? এটা কেমন কথা?
ধনু শেখ তামাক টানতে টানতে বললেন, থানার দারোগা সাহেব তদন্তে পেয়েছেন— তুমি মসজিদ পোড়ানোর সাথে জড়িত। অনেকে সাক্ষী দিয়েছে। অনেকে আমার কাছে এসেও বলেছে। তোমার নিজের লোকই আমাকে বলে গেছে।
আমার নিজের লোক আপনাকে বলেছে? সে কে? তার নামটা বলেন।
শ্ৰীনাথ বলেছে। টিকেট বাবুর চাকরির জন্যে আমার কাছে এসেছিল। তখন বলল। আমি যদিও তার কথার একটা বর্ণ বিশ্বাস করি নাই।
এককড়ি হতভম্ব হয়ে গেল। কী ভয়ংকর কথা। ধনু শেখ বললেন, শ্ৰীনাথকে ডেকে জিজ্ঞাস করা। তবে সে কিছু স্বীকার পাবে বলে মনে হয় না। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এ ধরনের কথা যেন আর না বলে। মন্দ কথা লোকজন সহজে বিশ্বাস করে।
রাগে এককড়ির শরীর জুলে যাচ্ছে। শ্ৰীনাথের বিষয়ে এক্ষুনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল। ধনু শেখ বললেন, বসে, মিষ্টি আনতে গেছে। দুষ্ট লোকের কথায় এত অস্থির হলে চলে না। এককড়ি বসল। চাল বিক্রির বিষয়টা আলাপ করতে হবে। নৌকা করে এত চাল নেয়া যাবে না। ধনু শেখের লঞ্চের সাহায্য লাগবে।
এককড়ি বলল, আপনার কাছে একটা বিষয়ে সাহায্যের জন্যে এসেছি। সামান্য কিছু চাল কিনে রেখেছিলাম। বোরো ফসল উঠার আগে বিক্রি করে দিব। আপনার লঞ্চে করে চাল নিয়ে যাব। কলিকাতা। কোনো সমস্যা আছে?
ধনু শেখ বললেন, কোনো সমস্যা নাই। তবে লোকজনের চোখের সামনে চালের বস্তা লঞ্চে তোলা ঠিক হবে না। নিশিরাতে তুলতে হবে।
অবশ্যই।
ধনু শেখ বললেন, চাল পঁচে যায় নাই তো?
এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, চাল পচবে কী জন্যে?
লুকায়া রাখা চাল। আলো বাতাস পায় নাই। অনেকের এরকম হয়েছে। সিউরাম নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর এক হাজার বস্তা চাল পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে এখন ন্যাংটা হয়ে পথে পথে ঘুরতেছে।
আপনাকে বলেছে কে?
কাগজে পড়লাম। ঢাকা প্ৰকাশে ছাপা হয়েছে।
আমার চাল ঠিক আছে।
তুমি সাবধানী মানুষ। তোমার সমস্যা হবার কথা না। যাই হোক, চাল কখন পাচার করতে চাও বলে। আমার লঞ্চ তৈয়ার থাকবে।
‘পাচার’ বলতেছেন কেন? আমি সৎভাবে চাল নিয়া যাব। বিক্রি করব। আমার মধ্যে দুই নম্বরি নাই।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। কথার কথা বলেছি।
এককড়ি বাড়ি ফিরেই গুদামের চাল পরীক্ষা করল। তাঁকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হলো। দুটা গুদামের চাল টিনের। টিনের ফুটা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। চাল পঁচে গেজে উঠেছে। তালাবন্ধ গুদাম কেউ খুলে নাই। এতবড় সর্বনাশ যে হয়ে গেছে তা বোঝা যায় নাই।
একজন এসে এককড়িকে জানাল যে, শকুন দূর হয়েছে। ত্ৰিশূলে আবার যেন এসে না বসে তার জন্যে বড়ই গাছের ডাল ভেঙে ত্রিশূলকে ঘিরে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। বড়ই কাটার জন্যে শকুন বসতে পারবে না।
বিপদ একা আসে না। সঙ্গী সাখী নিয়ে আসে। এককড়ি সন্ধ্যাবেলায় খবর পেল, কোলকাতায় তার দোকানটা লুট হয়েছে। এইখানেই শেষ না, তার নতুন খবরপাঠক দেবুকে টাকা ব্যাংকে জমা দিতে নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছিল। সে টাকা জমা না দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
এককড়ি সারারাত মন্দিরে বসে রইল। তার মধ্যে সে-রাতেই পাগলামির কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হলো। তার কাছে মনে হলো, ঠাকুর তাকে পছন্দ করেছেন এবং তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন। ঠাকুরের সঙ্গে তার নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো
ঠাকুর : কিরে মন বেশি খারাপ?
এককড়ি; আমি ধনেপ্ৰাণে গেছি ঠাকুর।
ঠাকুর : ধনে গেছিস ঠিক আছে। প্ৰাণ তো আছে।
এককড়ি : ধন বিনা প্ৰাণ দিয়ে কী করব ঠাকুর?
ঠাকুর : ধনের ব্যবস্থা করছি। আমি আছি না? গুপ্তধনের ব্যবস্থা হবে। এক কলসি মোহর হবে না?
এককড়ি : হবে। কবে পাব?
ঠাকুর : লাবুসের বাড়িতে যা। শিউলি গাছের আশেপাশে মাটিতে পোতা গুপ্তধন। খুঁড়ে বের কর।
এককড়ি : এখনি যাব?
ঠাকুর : তোর ইচ্ছা। তবে এত তাড়াহুড়া কী? আয় গল্প করি।
এককড়ি মাটি কাটার দু’জন কমলা এবং কোদাল নিয়ে ভোরবেলায় লাবুসের বাড়িতে উপস্থিত। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে একটা আলোচনা আছে।
লাবুস বলল, বলুন কী আলোচনা?
এককড়ি বললেন, আমার যে মহাসর্বনাশ হয়েছে এই খবর কি পেয়েছ?
কিছুটা শুনেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পাগল হয়ে গ্রামে বন্দরে ঘুরত। আমি বলেই এখনো ঠিক আছি। যাই হোক, মূল কথা এটা না। আমি একটা হাঁড়িতে কিছু সোনার মোহর ভরে তোমার ওই শিউলি গাছের গোড়ায় পুঁতে রেখেছিলাম।
ওইখানে কেন?
গোপন করার জন্যেই অন্যের জায়গায় রেখেছি। হরিচরণ বাবু এই বিষয়ে জানতেন। আমার এখন মহাবিপদ। মোহরগুলি নিতে এসেছি। দুটা মোহর তোমাকে আমি দিয়ে যাব।
লাবুস বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না। আপনার জিনিস আপনি নিয়ে যান।
ঠিক কোথায় পুতেছি এখন মনে নাই। অমাবশ্যার রাতে পুতেছি। দিক খেয়াল নাই। বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে।
করুন।
লাবুস, তুমি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে দুটা মোহর দিব। লাঙ্গরখানার কাজে লাগবে।
লাবুস বলল, লঙ্গরখানা তো উঠায়ে দিয়েছি।
এককড়ি বললেন, দেশে আবার অভাব আসবে, তখন নতুন লঙ্গরখানা চালু করবা। অর্থের সব সময়ই প্রয়োজন। তাহলে খোড়া শুরু করি?
করুন।
এককড়ি মহাউৎসাহে কাজ শুরু করলেন। রাতের দুশ্চিন্তার কিছুমাত্র এখন তাঁর চোখে-মুখে নাই। তাকে আনন্দিত এবং উৎফুল্ল লাগছে। তিনি পাটি বিছিয়ে বসেছেন। হাদিস উদ্দিন তার জন্যে বাজার থেকে ব্ৰাহ্মণের হুঙ্কা এনে দিয়েছে। এককড়ি হাদিস উদ্দিনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট। তিনি ঠিক করে রেখেছেন, গুপ্তধন পাবার পরপরই হাদিস উদ্দিনকেও খুশি করবেন। তাকে সোনার মোহর দেয়ার কিছু নাই! টাকা-পয়সা কিছু দিয়ে দিবেন। তিনি হাদিস উদ্দিনকে গলা নিচু করে বলে দিয়েছেন, তুমি কামলা দু’জনের দিকে নজর রাখবা। কঠিন নজর। এরা যেন কিছু পাচার করতে না পারে।