বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গাড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বংহি দুৰ্গা দশপ্ৰহরণ ধরিণী…
স্বদেশ বন্দনার নামে আন্দোলনকারীরা মুসলিম বিদ্বেষমূলক এই ‘বন্দে মাতরম’ গানকে জাতীয়সঙ্গীত হিসেবে চালু করে। একেশ্বরবাদী কোনো মুসলিম কি করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারত? এই কথাটা কোনো হিন্দু কংগ্রেস নেতাও কোনোদিন বুঝতে পারেন নি।
ধনু শেখের লঞ্চ
ধনু শেখের লঞ্চটি একতলা। কাঠের বডি। যাত্রী ধারণক্ষমতা পঞ্চাশ। লঞ্চ চলাচল শুরু করেছে। ধর্মপাশা সোহাগগঞ্জ রুটে। লঞ্চের নাম ‘এমএল বাহাদুর’। ‘কমলা’ নামই ঠিক ছিল, এর মধ্যে কমলার এক পুত্রসন্তান হওয়ায় নাম বদলেছে। ছেলের নাম বাহাদুর। তার নামে লিঞ্চের নাম। মেয়েছেলের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া ঠিক না। এতে দোষ লাগে। আয় উন্নতি হয় না।
মাওলানা ইদরিস দোয়া পড়ে লঞ্চে বখাশে দিয়েছেন। কালিবাড়ির পুরোহিত এবং অম্বিকা ভট্টাচাৰ্যও জবাফুল, গঙ্গাজল দিয়ে লঞ্চ শোধন করে দিলেন। সারেঙের ঘরে গণেশ মূর্তি বসানো হয়েছে। যাকে বলে আটঘটি বেঁধে নামা। নিজের লঞ্চ নিয়ে ধনু শেখ গেল ধর্মপাশায়। প্রাক্তন মুনিব নিবারণ চক্রবর্তীর আশীৰ্বাদ নিতে। উনাকে লঞ্চটা দেখানোর শখও আছে। নিবারণ চক্রবর্তী বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি লঞ্চ কোম্পানি খুলেছ?
ধনু বলল, জে কর্তা। একটাই এখন লঞ্চ— নাম দিয়েছি বাহাদুর। দোতলা একটা স্টিল বডি কিনার শখ আছে, যদি আপনের আশীৰ্বাদ পাই।
এত টাকা পাইলা কই? চুরি-ডাকাতি করছ নাকি?
ডাকাতি করার ইচ্ছাই ছিল, হঠাৎ একজন কিছু টেকা দিল।
সেই একজনটা কে?
জমিদার হরিচরণ বাবু।
কাছাখোলা জমিদার? কাছ খুইলা চলাফেরা করে। খড়ম পইরা জমিদারি দেখতে যায়। সে শুনছি। দুনিয়ার টাকা উড়াইতেছে। তোমারে হঠাৎ টাকা দিল কেন? তার মতলবটা কী?
ক্যামনে বলব। কেউ কানে ধইরা উঠবোস করায়, কেউ লঞ্চ কিন্যা দেয়কারণ বোঝা মুশকিল। দুনিয়া বড় জটিল।
ঠিক কইরা বলে তো, তুমি আমার আশীৰ্বাদ নিতে আসছি, নাকি অন্যকিছু?
অন্যকিছুই না।
হরিচরণ কি আমার পিছে লাগছে? তার সাথে তো আমার কোনো বিবাদ নাই। আমার ব্যবসা। তার জমিদারি।
উনার কথা মনেও আনবেন না। সাধু মানুষরে টানাটানি করা ঠিক না। উনি বিরাট সাধু।
আমারে উপদেশ দিবা না। কচুগাছের পাতা বড় হইলেই সে বটগাছ হয় না। কচুগাছ কচুগাছই থাকে।
অবশ্যই থাকে। খাঁটি কথা বলেছেন। এজাজত দেন, বিদায় হই।
ধনু শেখ হাসিমুখে বের হলো। নিজের লঞ্চে করে সোহাগগঞ্জ ফিরল। সারেং-এর ঘরে বাতাস খেতে খেতে ফেরা। এর মজাই অন্যরকম।
প্রথম মাসের লাভের অর্ধেক সে দিতে গেল। জমিদার হরিচরণকে। হরিচরণ বললেন, আমি তো তোমার সঙ্গে লঞ্চের ব্যবসায় নামি নাই।
ধনু শেখ বলল, তাহলে টাকা দিয়েছেন কী জন্যে?
তোমাকে সাহায্য করার জন্যে। বিরাট বিপদে পড়েছিলা। নিরন্ন দিন কাটাইতেছিলা। আমার কারণেই বিপদে পড়লা, তাই সামান্য সাহায্য।
টাকা ফেরত দেয়া লাগবে না?
অন্যভাবে ফেরত দিবা। ডিসিট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় মনিহারদির পুলটা ভাঙা। ভালো কাঠের পুল বানায়া দিবা।
পুল আপনে বানান।
আমার বানানো পুলে হিন্দুরা কেউ উঠবে না।
না উঠলে না। উঠবে। আপনের কী?
হরিচরণ চুপ করে রইলেন। ধনু শেখ তীব্রগলায় বলল, পুলে উঠবে না এইটা একটা কথা কইলেন? এরারে আমি থাপড়ায়া পুলে তুলব। আমার নাম ধনু।
হরিচরণ বললেন, ধনু নামের মানুষজন কি থাপড়াইতে ওস্তাদ?
ধনু জিব কাটল। মুরুব্বি মানুষের সামনে বেআদবি কথা বলা হয়েছে। তাকে আরো সাবধান হতে হবে। সে এখন বিশিষ্টজন। বিশিষ্টজনরা কথাবার্তা বলবে সাবধানে। হিসাব করে। একটা কথার আগে দশটা হিসাব।
বান্ধবপুরের আরেক বিশিষ্টজন মনিশংকর দেওয়ান। থাকেন কোলকাতায়। কাপড়ের ব্যবসা করেন। দুর্গাপূজা উপলক্ষে গ্রামে ফিরেন। বিরাট আয়োজনে দুর্গাপূজা হয়। প্রতিবছরই তিনি পূজা উপলক্ষে কিছু না কিছু মজার আয়োজন করেন। কখনো যাত্রা, কখনো ঘেটু গান, ম্যাজিক শো, সাহেববাড়ির বাজনা। শোনা যাচ্ছে, এ বছর তিনি বাইজি নাচাবেন। দেবী দুর্গার সঙ্গে পূজা গ্রহণের জন্যে কাৰ্তিকও আসেন। কার্তিক আবার বারবনিতাদের গান-বাজনার ভক্ত। তাঁর অবসর সময় কাটে স্বর্গের নটিদের নৃত্যগীতাদি শুনে। দেবী দুর্গার সঙ্গে মায়ের বাড়ি বেড়াতে এসে নিরামিষ সময় কাটানো তাঁর পছন্দ না। পূজার উদ্যোক্তারা তাঁর আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থা রাখার চেষ্টা নেন।
দুর্গাপূজার শুরুতে হরিচরণের কাছে এসে উপস্থিত হলেন শশী ভট্টাচার্য। থলেথলে পূজারি বামুন না। মোটামুটি ফিটফাট যুবা পুরুষ। বালক বালক চেহারা, মাথাভর্তি চুল। হালকা পাতলা শরীর। গায়ের বর্ণ গৌর। গায়ে হলুদ রঙের আলপাকার কোট । পায়ে চকচকে বার্নিশ করা জুতা। থিয়েটারের নায়কের পার্ট তাকে যে-কোনো সময় দেয়া যায়।
শশী ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমি ব্ৰাহ্মণ বিধায় আপনাকে প্ৰণাম করতে পারছি না। আপনি প্ৰণম্য ব্যক্তি।
হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার পরিচয়?
আমার নাম শশী ভট্টাচার্য। পিতা এককড়ি ভট্টাচাৰ্য, মাতার নাম যশোদা। তাঁরা বিত্তবান মানুষ। আমি তাদের একমাত্র সন্তান। তাঁরা সম্প্রতি আমাকে ত্যাগ করেছেন বিধায় আমি দেশে বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে এখানে উপস্থিত হয়েছি। এক দুদিন থেকে চলে যাব যদি অনুমতি দেন।