রাত অনেক হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার। অসংখ্য তারা উঠেছে। পুকুরঘাটে বসে লাবুস তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তার চোখে মুগ্ধ বিস্ময়। কী বিপুল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড! মানুষের বাস তার ক্ষুদ্র এক গ্রহে। না জানি অন্য গ্রহগুলিতে কী আছে। কী তাদের রহস্য।
হাসনাহেনা ফুল ফুটেছে। বাতাসে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। তারস্বরে ঝিঝি পোকা ডাকছে। লাবুসের মনে হলো ফুলের সৌরভ, ঝিঝির ডাক বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। বিপুল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের এরাও একটা অংশ। এবং মোটেই তুচ্ছ না।
লাবুস।
মাওলানা ইদরিস এসে লাবুসের পাশে বসলেন। লাবুস তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বাড়িতে পা দেয়ার পর বাড়িটা হেসে উঠেছে।
ইদরিস বললেন, বাবা, তোমার কথা বুঝলাম না।
লাবুস বলল, কোনো কোনো মানুষ আছে যারা যেখানেই যান। সেই জায়গা আনন্দে হেসে ওঠে। আবার উল্টাটাও হয়। কিছু মানুষের উপস্থিতিতে জায়গা কাঁদে।
বাবা, তোমার কথা কিছুই বুঝতেছি না।
লাবুস বলল, বুঝার দরকার নাই। আপনি যে কাজে গিয়েছিলেন সেই কাজ তো হয় নাই।
ঠিকই ধরেছ, কাজটা হয় নাই। তোমার অনেকগুলি টাকা নষ্ট করেছি। আমি শরমিন্দা।
আপনি যে সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি।
ফিরেছি ঠিকই, কিন্তু মনটা খারাপ। শশাংক পালের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারি নাই।
পূরণ হবে। আপনি যাকে খুঁজছেন সে খবর পাবে এবং একদিন ভরসন্ধ্যায় এই বাড়িতে সে উপস্থিত হবে।
ইদরিস তাকিয়ে আছেন। লাবুসের কোনো কথারই আগামাথা তিনি ধরতে পারছেন না। লাবুস বলল, মাঝে মাঝে আমি চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পাই।
ইদরিস বললেন, মানুষকে এই ক্ষমতা আল্লাহপাক দেন নাই বাবা।
লাবুস চুপ করে রইল। একটা কথা বলতে গিয়েও বলল না। সে যে কথাটা বলতে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে, আপনি যে মেয়ের সন্ধানে গিয়েছিলেন তার নাম আপনি আমাকে বলেন নাই। কিন্তু আমি তার নাম জানি। তার নাম ললিতা। মাওলানা ইদরিসকে চমকে দেয়ার কোনো অর্থ নাই।
কলিকাতা শহর কেমন দেখলেন?
ভালো না। দমবন্ধ লাগে। তবে কয়েকজন অতি ভালোমানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এদের মধ্যে একজন স্কুল শিক্ষক। গোপালনগর স্কুল। বিভূতি বাবু।
লেখক?
হ্যাঁ লেখক। অনেক বই লিখেছেন। উনিও এখানে আসবেন। আপনি তাঁকে তিনবটের মাথা দেখাতে নিয়ে যাবেন।
মাওলানা ইদরিস অবাক হয়ে বললেন, বিভূতি বাবুকে আমি তিনবটের মাথার কথা বলেছি। উনি সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখতে পছন্দ করেন। উনি বলেছেন আসবেন। তাঁর শরীর সামান্য খারাপ। শরীর সারলেই আসবেন।
হঠাৎ লাবুস পরিষ্কার দেখতে পেল, লেখক মানুষটা পুকুরঘাটের শ্বেতপাথরে বসে আছেন। মুগ্ধ গলায় নিজের লেখা পড়ে যাচ্ছেন।
এককড়ির মন্দিরের চূড়া
এককড়ির মন্দিরের চূড়ার ত্ৰিশূলে গলাছিলা বিকটদৰ্শন এক শকুন এসে বসেছে। সে আকাশের দিকে গলা লম্বা করছে, আবার গুটিয়ে আনছে। পাখা মেলে দিচ্ছে এবং বন্ধ করছে। তার চকচকে ক্রুদ্ধ লাল চোখ দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।
মন্দির চূড়ায় শকুন বসা বিরাট অলক্ষণ। মহাবিপদের অগ্রিম ইশারা। শকুন তাড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢ়িল ছোড়া হচ্ছে। গুলতিতে করে মার্বেল ছোড়া হচ্ছে। শকুন নির্বিকার। এইসব কর্মকাণ্ড সে মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না। কিছুক্ষণ খোল করতাল বাজানো হলো। শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে সে উড়ে গেল ঠিকই, আবার এসে বসল। এই দফায় দেখা গেল তার ঠোঁটে মাংস। কিসের মাংস কে জানে! মরা গরুর মাংস হলে সর্বনাশ। মন্দির অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মন্দির শুদ্ধি বিরাট আয়োজনের ব্যাপার।
এককড়ির উপদেশে বাঁশের আগায় খড় বেঁধে সেই খড়ে আগুন লাগিয়ে চেষ্টা শুরু হয়েছে। পশুপাখি আগুন ভয় পায়। এই শকুনটা যত হারামিই হোক আগুন দেখে অবশ্যই পালাবে। এককড়ি বললেন, আধঘণ্টা সময়, এর মধ্যে শকুন দূর করবা। প্রয়োজনে একজন কেউ মন্দিরের মাথায় উঠ। এতগুলি মানুষ একটা শকুন দূর করতে পার না, এটা কেমন কথা!
এককড়ি তার আড়তে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকল। মন অস্থির লাগছে। শকুন দূর না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা কাটবে না। তাঁর ব্যক্তিগত মন্দিরে শকুন বসেছে, বিপদ যা হবার তার হবে। বিপদের কিছু সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। চালের দাম কমতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। এইবার ফসল ভালো হয়েছে। ইংরেজ সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই ভারতকে স্বাধীন করে দেয়া হবে। এটা আরেক যন্ত্রণা। ইংরেজ রাজার জাত। তারা যেভাবে রাজত্ব করেছে সেভাবে কে পারবে? হিন্দু-মুসলমান কাটাকাটি করেই তো মরে যাবে।
এককড়ি শকুনের খবর নিল। শকুন এখনো যায় নাই। ঠিক হয়েছে। একজন মন্দিরের চূড়ায় অলঙ্গা দিয়ে চেষ্টা করবে। অলঙ্গা সুপারিকাঠের বর্শা। বর্শাধারী স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নিচ্ছে। এককড়ি উঠে দাঁড়ালেন। ধনু শেখের সঙ্গে ব্যবসা বিষয়ে পরামর্শ করবেন। গুদামে রাখা চাল পার করতে ধনু শেখের সাহায্য লাগবে। একজন ব্যবসায়ী আরেকজনকে সাহায্য করে। এটাই নিয়ম। সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না। এককড়ি ছোট্ট ভুল করে ফেলেছেন। সব চাল আগেই বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল। তবে সময় এখনো আছে।
ধনু শেখ যত্ন করে এককড়িকে বসিয়েছেন। পান-তামাক দেয়া হয়েছে। একজন গেছে মিষ্টি আনতে। মুসলমানের ঘরে দুগ্ধজাত খাদ্য ছাড়া অন্য খাদ্য গ্রহণ করা যায় না। দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য সব অবস্থায় পবিত্র। ধনু শেখ বললেন, মসজিদটা ঠিক করে দিলা না? এক মাসের উপর হয়ে গেল জুম্মার নামাজ বন্ধ।