জি আম্মা বুঝলাম। এই বাড়িতে কি ভূত আছে?
অবশ্যই আছে। ভূত ছাড়া কি বাড়ি হয়? তিন চাইরটা আছে, এর মধ্যে একটা বড়ই বজাত— নাম ‘হাম্বর’।
ভূতদের নাম থাকে?
অবশ্যই থাকে।
আম্মা, ‘হাম্বর’ ছেলে না মেয়ে?
ছেলে। সন্ধ্যাবেল বাঁশঝাড়ের কাছে হাম্বর বলে ডাক দিও, দেখবা ঘটনা।
কী ঘটনা?
বাতাস নাই কিছু নাই দেখবা সমানে বাঁশগাছ দুলতাছে।
মোসাম্মত আমিনা বেগম শুধু যে ভূতের গল্প করেন তা না—প্রতি অমাবশ্যায় ভূতদের উদ্দেশে ভোগ দেন। আস্ত গজার মাছ ভেজে বাঁশগাছের নিচে রেখে আসেন। গজার মাছ ভাজা ভূতপ্রেতের অতি পছন্দের খাবার। জিনরা আবার মাছ খায় না। তাদের পছন্দ ছানার মিষ্টি।
একদিন আতর বলল, আম্মা, গজার মাছ ভাজা দেওয়া ঠিক না। মাছ ভাজার লোভে অন্য ভূতরা চলে আসবে। বাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে ভূত পোতনিতে।
আমিনা বেগম পুত্রবধুর অজ্ঞতায় খুব মজা পেলেন। তিনি বললেন, এক সীমানার ভূত অন্য সীমানায় যায় না। তাছাড়া হাম্বর আছে। হাম্বর কাউরে ধারে কাছে আসতে দিবে না।
হাম্বরকে কোনোদিন দেখেছেন?
বৌমা, এদের চোখে পরিষ্কার দেখা যায় না। তারপরেও কয়েকবার দেখেছি। খুবই খাটো। পায়ের পাতা অনেক বড়। মুখের কাটা ছোট। পুতি পুতি দাঁত। ইন্দুরের দাঁতের মতো।
আমাকে একদিন দেখাবেন?
আচ্ছা যাও চেষ্টা নিব। দেখতে পাবা কি-না জানি না। সবাই দেখে না।
আমিনা বেগম চেষ্টা নিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা আতরকে বাঁশঝাড়ের কাছে নিয়ে গেছেন— হাম্বরের সঙ্গে আতরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। উঁচু গলায় বলেছেন, ঐ হাম্বর। বিদের বাচ্চা কইরে? বউমারে নিয়া আসছি। ভালো কইরা দেখ। এর সাথে বিজাতি ফাইজলামি করবি না। ভয় দেখাবি না। নজর দিবি না। অন্য কোনো বিদের বাচ্চা যেন নজর না দেয় সেইটাও দেখবি। তুই যে আমার কথা শুনিছস তার প্রমাণ দে। বাঁশঝারে বাকি দে বিদের বাচ্চা।
বাঁশঝাড় সত্যি সত্যি দুলে উঠল। আতর ভয়ে তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরল। আমিনা বেগম বড়ই তৃপ্তি লাভ করলেন। কেউ ভূতের ভয়ে অস্থির হলে তিনি খুব আনন্দ পান। তার মনে হলো— ভালো বৌ পেয়েছেন। মাশাল্লাহ!
অল্প কিছু দিনেই আতর বুঝে ফেলেছে তার স্বামী একজন ব্যর্থ মানুষ। সে যে ব্যর্থতা নিজে জানে না। ব্যর্থ মানুষরা ক্ষতিকর হয়, এই লোকটা তা না। সে বাস করে প্রবল ঘোরে। এই ঘোর কোনোদিন কাটবে তাও মনে হয় না।
শাহনেয়াজের বর্তমান কর্মকাণ্ড দুই ভাগে ভাগ করা। কাব্যচর্চা এবং মূর্খ স্ত্রীকে শিক্ষিত করা। আতরকে প্রতিদিন গল্প-উপন্যাস পড়তে হচ্ছে। শুধু পড়াতেই শেষ না, মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।
যে উপন্যাস পড়ে শেষ করেছ, তার নাম কী?
নৌকাড়ুবি।
কে লিখেছেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নায়কের নাম কী?
রমেশ।
নায়িকার নাম কী?
সুশীলা।
পার্শ্বচরিত্রের নাম কী?
আতর বলল, পার্শ্বচরিত্র কী জিনিস?
শাহনেয়াজ বলল, যে নায়ক নায়িকা না, তবে তাদের আশেপাশের কেউ।
জানি না।
উপন্যাসটা তোমাকে আবার পড়তে হবে। কাগজ-কলম নিয়ে বসবে। যখনই কোনো নাম আসবে নাম লিখে ফেলবে।
আতর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আতরকে তার স্বামীর কিছু কবিতাও মুখস্থ করতে দেয়া হয়েছে। একটি কবিতার নাম ‘চাতকের অশ্রু’।
চাতকের অশ্রু
নিশি পথের পেয়েছি নিমন্ত্রণ
শুনেছি ক্ৰন্দন।
ব্যথিত চাতক কাঁদে দুলে উঠে বন।
উড়ে যায় পক্ষীগণ।
বহে বায়ু উত্তরী, শন শন শন।
উচাটন হয়েছে তাহদের মন।
হইতেছে দুঃখের শোণিত ক্ষরণ।
কবিতা মুখস্থ করা ছাড়াও আতরকে যে কাজটি করতে হচ্ছে তা হলো সেজেগুজে কবির সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকা। কারণ কবি প্রচুর প্রেমের কবিতা লেখেন। সেই সময় ‘প্রেরণাদাত্রী’ লাগে। বসে থাকার সময় হাসা যাবে না। নড়াচড়াও করা যাবে না। এতে কবির মনসংযোগে সমস্যা হয়।
আতর শিবশংকরের চিঠি পেয়েছে। চিঠির অর্থ, কে এই চিঠি পাঠিয়েছে, সে কিছুই বুঝতে পারে নি। সে চিঠি তার স্বামীকে দেখিয়েছে। তার বিদ্বান স্বামী চিঠির অর্থ সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছে। গম্ভীর গলায় বলেছে, এটা তাবিজ। কেউ একজন চিঠির মাধ্যমে তোমাকে তাবিজ করেছে।
তাবিজ কেন করেছে?
তোমার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়।
তাবিজ পানিতে ড়ুবিয়ে দিলে তার গুণ নষ্ট হয়। আয়োজন করে সেই তাবিজ পানিতে ড়ুবানো হলো। শাহনেয়াজ ঘোষণা করল, যেহেতু কেউ একজন তার স্ত্রীকে তাবিজ করার চেষ্টা করছে, কাজেই সে স্ত্রীকে ফেলে কোলকাতা যাবে না এবং এবছর এমএ পরীক্ষা দেবে না।
আব্দুল গনি বলেছেন, ঠিক আছে দিস না। আগেও দুইবার ফেইল করছস, এইবারও কারবি। লাভ কী? পাস করলেও বিপদ। আরো বড় গাধা হবি।
শাহনেয়াজ বলল, বড় গাধা কেন হ’ব?
আব্দুল গনি হতাশ গলায় বললেন, ভুল বলেছি। বড় গাধা হবি না। তুই বড় গাধা হইয়াই জন্ম নিছস।
বাবার অপমানসূচক কথায় কবি সাহেবের কোনো ভাবান্তর হলো না। হালকা ধরনের কথাবার্তা শুনলে তার হবে না। সে জগতের মহৎ বিষয় অনুন্ধানে ব্যস্ত। তাছাড়া গতকাল রাত তিনটা একুশ মিনিটে তার মাথায় কবিতার একটা লাইন এসেছে। লাইনটা জেকে বসেছে। পিন আটকে যাওয়া রেকর্ডের মতো বেজে যাচ্ছে। লাইনটার ব্যবস্থা করা দরকার। লাইনটা হচ্ছে—
‘সরবোরে নীল কমলিনি কাদে।’
নীল কমল কাঁদলে ঠিক ছিল। কিন্তু কমলের স্ত্রীলিঙ্গ কমলিনি’ কেন মাথায় এসেছে তা কবি বুঝতে পারছে না।