জানি না।
মনিশংকর হরিদ্বার থেকে রক্ষাকবচ এনে ছেলেকে পরিয়েছিলেন। একদিন দেখেন সেই রক্ষাকবচ খুঁটির মাথায় লাগানো। মনিশংকর ছেলেকে ডেকে বললেন, কাজটা কেন করেছ?
শিবশংকর বলল, কবচে আমার বিশ্বাস নাই।
কিসে তোমার বিশ্বাস?
কিসে বিশ্বাস সেটা আমি জানি। কিন্তু আপনাকে বলব না।
কেন বলবে না?
কারণ আপনি বুঝতে পারবেন না।
মনিশংকর ঠিক করেছেন ছেলেকে বান্ধবপুর থেকে কোলকাতা নিয়ে যাবেন। জাপানিরা বোমা ফেললে ফেলবে। কী আর করা। বোমার চেয়েও জরুরি ছেলের চিকিৎসা। ছেলেকে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করতে হবে। তিনি এই মুহূর্তে কাজটা করছেন না, কারণ খুঁটি পুতার সমস্যা ছাড়া ছেলে ভালো আছে। বিপুল উৎসাহে লঙ্গরখানার কাজ করে যাচ্ছে। ইমাম করিমের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। কাজকর্মের ফাঁকে দু’জনে নানান কথা বলে।
করিম তার মনের অতি গোপন পরিকল্পনার কথাও শিবশংকরকে বলেছে। তার পরামর্শ চেয়েছে।
করিম ফিসফিস করে বলেছে, তিনজন মানুষকে খুন করা ফরজ হয়ে গেছে। বুঝেছি, ফরজ হয়ে গেছে।
শিবশংকর বলল, ফরজ কী?
করিম বলল, ফরজ হলো অবশ্য কর্তব্য। তিনজনের মধ্যে একজন হলো ধনু শেখ।
বাকি দু’জনের নাম বলবেন না?
না। দেখি তুমি অনুমান করে বার করতে পার কি না।
তারা কি পুরুষ?
একজন পুরুষ। আরেকজন মহিলা।
তাদের বয়স কত?
ইমাম বলল, থাক বেশি চিন্তার দরকার নাই। আমি নাম বলতেছি। গোপন রাখবা। পুরুষের নাম লাবুস।
লাবুস?
হুঁ। আর মেয়েটার নাম আতর।
আতর? সে তো খুব ভালো মেয়ে।
ইমাম অবাক হয়ে বলল, আতরের কারণে আমার স্ত্রী থাকে নটিবাড়িতে। ভালো কীভাবে হয়?
আতরকে কীভাবে খুন করবেন? সে তো বান্ধবপুরে থাকে না। বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
করিম বলল, শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা বের করেছি, সেখানে যাব।
মানুষ খুন করবেন, আপনার পাপ হবে না?
হবে না। আমি পাগল তো— পাগলের পাপ নাই।
আপনার কথাবার্তা তো পাগলের মতো না।
করিম বলল, কথাবার্তা পাগলের মতো না। কিন্তু হাসি পাগলের মতো। এই দেখ আমি হাসব— পাগলের হাসি।
করিম শরীর দুলিয়ে বিকট শব্দে হাসতে লাগল।
শিবশংকর বলল, পাগলের কি ধর্ম আছে?
করিম বলল, না। পাগলের ধর্ম নাই। তার কাছে আল্লাহ ভগবান সব এক।
কিন্তু আপনি তো নামাজ পড়েন। পাঁচ বেলাই পড়েন। তার অর্থ আপনি পুরোপুরি পাগল হন নাই। কিছু বাকি আছে।
কথা খারাপ বলো নাই।
এখন খুন করলে বিরাট পাপ হবে।
তাও ঠিক।
শিবশংকর বলল, পুরাপুরি পাগল হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেন।
করিম বলল, এছাড়া উপায় কী?
শিবশংকর বলল, আতরের ঠিকানাটা আমাকে দিবেন?
তুমি ঠিকানা দিয়া কী করব?
একটা চিঠি লিখব।
আচ্ছা ঠিকানা দিব, কোনো সমস্যা নাই। ঠিকানা তোমার কাছে থাকাই ভালো। আমি হারায়ে ফেলতে পারি।
শিবশংকর আতরকে চিঠি লিখেছে। চিঠিটা লিখেছে। সংকেতে। তার ধারণা আতর সংকেত ধরতে পারবে। শিবশংকরের চিঠি–
A ১০০১২—দণ্ড—৩২০১—দণ্ড
৮৮৮৯—Pok—৫৫২—০১—N
MAGO TREE. ২১১—০০০
৬১১৯৩৭২ অ—আ—শ
আতর তার শ্বশুরবাড়িতে সুখেই আছে। তাদের বাড়িটা টিনের। বেশ বড় বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। এই পুকুর মেয়েদের। মেয়েরাই শুধু সেখানে স্নান করবে, ধোয়া পাকলার কাজ করবে। পুরুষদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। পুকুরের পেছনে ঘন বাঁশঝাড়। বাড়ির সামনে বড় উঠান। উঠানে কয়েকটা আমগাছ। একটা আমগাছে দোলনা টানানো। এই দোলনা কবি শাহনেয়াজের জন্যে। মাঝে মাঝে কবি সাহেব দোলনায় দোল খেতে খেতে কবিতা লিখতে পছন্দ করেন। এতে নাকি ছন্দের হিসাব রাখতে সুবিধা হয়।
আতরের দিন শুরু হয় তার শ্বশুর আব্দুল গনির গজগজানি দিয়ে। তিনি পুত্রকে দীর্ঘক্ষণ গালাগালি না করে তার দিন শুরু করতে পারেন না। শাহনেয়াজ বাবার গালাগালি কিছুই শোনে না। কারণ সূর্য ওঠার পর পরই সে ঘুমাতে যায়। তার ঘুম ভাঙে দুপুরে। ঘুম ভাঙার পরপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। এই ঘুমের নাম ভাত ঘুম। ভাত ঘুম ভাঙে বিকালে। শাহনেয়াজ তখন গোসল সারে, দাঁত মাজে, ইন্ত্রি করা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে তার দিন শুরু করে।
শাহনেয়াজের বাবা আব্দুল গনি তাঁর দিন শুরু করেছেন। পুত্রকে নিয়ে গজগজানি শুরু হয়েছে- বিদ্বান গাধা এখন ঘুমে। বিদ্যার খেতায় আগুন। এমন বিদ্যার প্রয়োজন নাই। মূর্খ ভালো। টেকা পয়সা খরচ কইরা যে পুলারে বিদ্বান বানায় সে গাধা। তার বাপ গাধা। তার দাদা গাধা। তার চৌদ্দগুষ্ঠি গাধা। তার মাতুল বংশ গাধা। ইত্যাদি।
আতরের শাশুড়ি মোসাম্মত আমিনা বেগম নামাজ কালাম নিয়ে থাকেন। তার হাতে এক হাজার গুটির তসবি। একজন দাসী সৰ্ব্বক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকে এবং তসবির একটা মাথা ধরে থাকে। এই তসবি এক পীরসাহেব তাকে দিয়েছেন।
আমিনা বেগম অবসর সময় বাড়ির পেছনে পুকুরঘাটে বসে থাকেন। তিনি যেখানে সেখানে ভূত দেখেন। ভূতের গল্প বলায় তার আগ্রহ সীমাহীন। শ্রোতা হিসাবে আতরকে পেয়ে তিনি খুশি। তিনি তাঁর ছেলের বউকে ভূতবিষয়ক শিক্ষায় পুরোপুরি শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই দায়িত্ব তিনি আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে পালন করছেন।
বৌমা শোন। ভূত পেতনি আর জিন কিন্তু এক না। ভূত পেতনি এক কিসিম, জিন আরেক কিসিম। জিনরার দেশ আছে। রাজত্ব আছে। রাজা আছে। ভূত পোতনির এইসব কিছু নাই। বুঝলা ঘটনা?
জি আম্মা বুঝলাম।
ভূত পেতনি আবার দুই কিসিমের। শুকনার ভূত। এরা গাছে থাকে, মানুষের বাড়িঘরে থাকে। আরেক কিসিন্ম হইল পাইন্যা ভূত। এরা থাকে পানিতে—খালে, বিলে, হাওরে। বুঝলা ঘটনা?