খুট করে শব্দ হলো। এককড়ির ধ্যান ভঙ্গ হলো। শ্ৰীনাথ দরজা খুলে ঢুকেছে। এককড়ি বললেন, ধ্যানে যখন থাকি হুটহাট শব্দ করা, এটা কেমন কথা!
শ্ৰীনাথ বলল, আপনি ধ্যানে আছেন বুঝব ক্যামনে? দরজা বন্ধ। তারচে’ বড় কথা, সামান্য শব্দে যে ধ্যান ভাঙে সেই ধ্যান কোনো ধ্যানের মধ্যেই পড়ে না।
এককড়ি বললেন, তুমি অতিরিক্ত মাতব্বর হয়ে গেছ শ্ৰীনাথ। তালেবারের মতো কথা বলা শুরু করেছ। শুনেছি। তুমি নামশূদ্রর সাথে মারামারি করেছ।
শ্ৰীনাথ বলল, নরেশ আমারে অপমান করেছিল, আমি তারে দুই চারটা থাপ্নড় দিয়েছি। এটা কোনো বিষয় না। শ্ৰীরামচন্দ্র কী করেছিলেন শুনেন- শম্বুক নামের এক শূদ্র ‘রাম রাম’ বলে উঠল। শূদ্রের মুখে রামনাম নিষিদ্ধ। কাজেই শ্রীরাম চন্দ্র নিজের হাতে শম্বুককে হত্যা করলেন।
এককড়ি বললেন, তুমি কি রামচন্দ্র? তুমি রামচন্দ্র না। তুমি শ্ৰীনাথ। বিরাট চোর।
চোরা?
অবশ্যই চোর। তুমি লাবুসের বাড়ি থেকে কৃষ্ণমূর্তি চুরি কর নাই?
করেছি। আপনার জন্যে করেছি। নিজের জন্যে করি নাই।
এককড়ি বললেন, আমার মন বলতেছে- নানান দুষ্কর্ম তুমি ভবিষ্যতে করবা এবং পরে বলবা— কাজটা আপনার জন্যে করেছি। কাজেই তুমি বিদায়।
কী বললেন?
বললাম, বিদায়। আজ থেকে তুমি আমার সঙ্গে নাই।
আমি যাব কই? খাব কী?
তুমি রামচন্দ্ররে ডাক। উনি ব্যবস্থা করে দিবেন। এখন সামনে থেকে যাও। এককড়ি ধ্যানে মন দিলেন—
হে নাথ করুণাসিন্ধু
দীনবন্ধু কৃপাং করো
ত্বং মহেশ মহাজাতা
দুঃস্বপ্নং মাং ন দর্শয়।।
শ্ৰীনাথ ধনু শেখের কাছে গিয়েছে। ধনু শেখ লঞ্চের জন্যে নতুন টিকেট বাবু নেবেন। কাজটা যদি পাওয়া যায়।
ধনু শেখ বললেন, অবশ্যই তোমারে চাকরি দিব। লঞ্চের টিকেট বাবুর জন্যে চতুর লোক লাগে। তোমার মতো চতুর তো সচরাচর পাওয়া যায় না। গরু-ছাগল পাওয়া যায়। নির্বোধি পাওয়া যায়। চতুর পাওয়া যায় না।
শ্ৰীনাথ বিড়বিড় করে বলল, বিরাট কষ্টে আছি। বলতে পারেন না খায়া আছি।
এককড়ি বললেন, না খায়া কেন থাকবা? লাবুসের লিঙ্গরখানা আছে না? সেখানে ভর্তি হয়ে যাও। একবেলা ভরপেট খিচুড়ি।
শ্ৰীনাথ বলল, সেটা সম্ভব না। একটা চাকরি দেন— আমি বাকি জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।
বলেছি তো চাকরি দিব। একটা শর্ত আছে। কঠিন কিছু না।
শ্ৰীনাথ বলল, যে শর্ত দেন সেটাই মানব।
ধনু শেখ বললেন, আমি ঠিক করেছি। স্বজাতি ছাড়া চাকরি দিব না। মুসলমান হয়ে যাবে। জটিল কিছু না। তিনবার কলিমা পড়লেই হবে।
শ্ৰীনাথ হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে। এখন মনে হচ্ছে, এই আধাপাগল মানুষটার কাছে আসাই ভুল হয়েছে।
ধনু শেখ পান মুখে দিতে দিতে বললেন, কলিমা পড়ার পর তোমার ‘ধন’ কাটা হবে। সামান্য রক্তপাত, তবে অনেকের ‘ধন’ জন্ম থেকে কাটা থাকে। তাদের কাটা লাগে না।
শ্ৰীনাথ বলল, এইগুলা কী বলতেছেন?
ধনু শেখ বললেন, ধুতি খুলে তোমার ধনটা আমারে দেখাও। আমি দেখলেই বলতে পারব তোমার কাটা লাগবে কি-না।
শ্ৰীনাথ দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ধনু শেখ মনের আনন্দে অনেকক্ষণ হাসলেন। একটা বয়সের পর সহজে আনন্দ পাওয়া যায় না। আনন্দ খুঁজে খুঁজে নিতে হয়। জগতে আনন্দই সত্য। আর সব মিথ্যা।
তিনি গোপনে একটা আন্দোলন শুরু করেছেন। এই আন্দোলনের নাম ‘বান্ধবপুর ছাড়’। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ছোটটা। কায়দা করে এই অঞ্চল থেকে হিন্দু দূর করা। দেশ ভাগাভাগি হবে বোঝাই যাচ্ছে। বান্ধবপুর হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।
ধনু শেখের মনে হচ্ছে গান্ধিজি যেমন জেল থেকে ছাড়া পেয়েই নিজগ্রামে ফিরে গেছেন, ঠিক সেরকম আরেক গান্ধিও বান্ধবপুরে এসেছে। তার নাম মাওলানা ইদরিস। চুল দাড়ি ফেলে হাতে লাঠি নিয়ে উপস্থিত! হাঁটছেও কুজো হয়ে। দিনরাত নাকি কাকের ছবি আঁকছে। কলিকাতা থেকে এই বিদ্যা নিয়ে এসেছে।
সদরুল।
কর্তা বলেন।
ঝিমায়া বইসা আছ কেন? কিছু কর।
কী করতে বলেন?
সব আমাকে বলা লাগবে কেন? বুদ্ধি খাটায়া কিছু বের কর।
সদরুল বুদ্ধি খাঁটিয়ে কিছু বৈর করতে পারছে না। ধনু শেখ কী চাচ্ছেন বুঝতে পারছে না। গুরুত্বপূর্ণ কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। সে কারো সঙ্গে আলাপও করতে পারছে না। একবার ভোবল লাবুসের সঙ্গে আলাপ করবে। লাবুস মানুষটা শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তা-না। ভালোমানুষও। ভালোমানুষের চিন্তা হবে ভালোমানুষের মতো। সেই চিন্তা কি ধনু শেখের পছন্দ হবে?
শিবশংকর লঙ্গরখানা নিয়ে কঠিন পরিশ্রম করছে। জঙ্গল থেকে রান্নার খড়ি আনার মতো কাজও করছে। লাবুস তাকে বাধা দিচ্ছে না। মনিশংকর বলে দিয়েছেন, ছেলে যা করতে চায়। তাই যেন তাকে করতে দেয়া হয়। আমার ছেলের কোনো একটা বড় সমস্যা হয়েছে। কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকলে যদি সেই সমস্যাটা কাটে।
বাড়ির সামনে খুঁটি পুতে রাখার বিষয়েও তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। ছেলে উত্তর দিয়েছে, সেই উত্তরের কোনোই অর্থ হয় না।
বাবা, খুঁটি কেন পুঁতে রাখ? আমাকে বলতে যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে বলো।
আমাকে একজন পুতিতে বলেছে।
সে তোমার পরিচিত?
হুঁ।
হিন্দু না মুসলমান?
বাবা, আমার ধর্মে বিশ্বাস নাই। আমি হিন্দু-মুসলমান আলাদা করি না।
যে তোমাকে খুঁটি পুঁতিতে বলেছে সে ছেলে না মেয়ে?
তোমার পরিচিত কেউ?
হ্যাঁ।
জীবিত না মৃত?
বাবা সে মৃত।
এটা কি ভৌতিক কোনো ব্যাপার?