মাওলানা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘কাউয়া’ আঁকলেন। মীরার আনন্দের সীমা রইল না। একসময় সে বলল, বাবা, কাউয়া ছাড়া তুমি আর কিছু আঁকা জানো না?
না। একটাই আঁকতে শিখেছি।
কে তোমারে শিখায়েছে? আল্লাহ।
ঠিকই ধরেছ। উনিই শিখায়েছেন, তবে অন্যের মাধ্যমে।
মাধ্যম কী?
মাওলানা বিপদে পড়লেন। মাধ্যম মেয়েকে বুঝবেন কীভাবে? এত কথা সে কীভাবে বলে এটাও রহস্য।
বাবা, আরো কাউয়া বানাও।
মাওলানা মেয়ের আনন্দ দেখে অভিভূত হলেন। তিনি মনে মনে বললেন, আল্লাহপাক, তুমি আনন্দ তৈরির কারিগর। আমার মেয়েটার মনে তুমি যে আনন্দ তৈরি করেছি। তার জন্যে তোমার পাক দরবারে শুকরিয়া।
মাওলানা ইদরিসের মতো আরেকজন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরেই হাতজোড় করে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মূর্তির সামনে বসে আছেন। তিনি বিড়বিড় করে বলছেন, ঠাকুর, আমার পুত্ৰ এখন সর্ব রোগব্যাধি থেকে মুক্ত। ঠাকুর, এই কাজ হরিচরণের মাধ্যমে তোমারই করা। আমার আনন্দের সীমা নাই।
তিনি ঠাকুরকে ফুল নিবেদন করলেন। তারপর শিবশংকরকে ডেকে পাঠালেন।
বাবা, তোমার শরীর কেমন?
শরীর ভালো।
সব সময় খেয়াল রাখবে ঋষি হরিচরণ তোমার দিকে লক্ষ রাখছেন। উনার নির্দেশমতো কাজ করায় আজ তুমি নীরোগ।
শিবশংকর বলল, স্বপ্ন কোনো বিষয় না। বাবা। মানুষ যা ভাবে তাই স্বপ্ন দেখে। সারাক্ষণ তোমার মাথায় ঋষি হরিচরণ থাকে বলে তুমি উনাকে স্বপ্নে দেখ।
মূর্থের মতো অন্যায় কথা বলেছ। ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চাও।
শিবশংকর বলল, আমি ঠাকুরদেবতা মানি না বাবা। আমি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য। আমি স্বামীজির মতো নাস্তিক।
বিবেকানন্দ নাস্তিক?
হুঁ। উনি বলেছেন, ‘যে ঈশ্বর ক্ষুধায় পৃথিবীর মানুষকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি পরকালে আমাদের পরম সুখে রাখিবেন ইহা আমি বিশ্বাস করি না।’
মনিশংকর হতভম্ব গলায় বললেন, স্বামীজি এই কথা বলেছেন? ভগবান রামকৃষ্ণের একনম্বর ভক্ত এই কথা বলেছেন?
শিবশংকর বলল, বইয়ে লেখা আছে। আমার কাছে বই আছে, দেখাব?
না, দেখাতে হবে না। আমি আগামী দুইদিন তোমার মুখ দৰ্শন করব না।
পুত্রের পাপের ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে মনিশংকর ঠিক করলেন, আগামী দুই দিন তিনি নিরন্তু উপবাস করবেন। ঠাকুরঘর থেকে বের হবেন না। একমনে জপ করবেন–
পুত্ৰকে ক্ষমা কর ঠাকুর।
অবোধকে ক্ষমা কর।
নির্বোধকে ক্ষমা কর।
মূর্খকে ক্ষমা কর।
এককড়ি তাঁর নিজস্ব ঠাকুরঘরে বসে আছেন। সম্পূর্ণ নিজের আলাদা ঠাকুর থাকার আনন্দ এখন বোধ করছেন। তাঁর নিজের ঠাকুর এখন তাকেই দেখবেন, অন্যকে না।
আজ এককড়ির মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত। শ্ৰীনাথের কারণে বিক্ষিপ্ত। সে না-কি নমস্তদ্বদের সাথে মারামারি করে এসেছে। কাজটা ভুল হয়েছে। ছোটজাতকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হয়। ছোটজাতকে কখনো খেপিয়ে তুলতে নেই। এরা থাকে। দলবদ্ধ। সব একসঙ্গে হলে বিরাট ঝামেলা করতে পারে। তার চালের গুদাম লুট করতে পারে। আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। কিছুদিন আগে বাজারের দোকানে আগুন লাগল। এই আগুনের পেছনে নমশুদ্রের দল থাকতে পারে। ছোটলোকরা ধনবানদের দেখতে পারে না।
বান্ধবপুরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা যেটা হয়েছে তার পেছনে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ আছে, এটা তার মনে হয় না। ঠিকমতো তদন্ত হলে সব বের হতো। তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে না। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ ময়মনসিংহ সদর থেকে এসপি সাহেব আসেন নাই। ইংরেজ এসপি এসে একটু হস্থিতম্বি করলে থলের বিড়াল বের হয়ে যেত। এসেছে কে? ঘোড়ায় চড়ে কেন্দুয়া থানার ওসি। ওসি মুসলমান। নাম হায়দার। এককড়ির উঠানে বসে ডাব খেতে খেতে বলেছেন, এককড়ি বাবু, মসজিদটা পুড়ায়ে দিয়ে ভালো করেন নাই।
হতভম্ব এককড়ি বললেন, মসজিদ পুড়ায়ে দিয়েছি, এটা কী বললেন?
ওসি সাহেব বললেন, মসজিদের ঈমাম সাহেব মারা গিয়েছেন, সেটা বড় কথা না। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় মানুষ মরবেই। কিন্তু মসজিদ- ধর্মস্থান পুড়য়ে দেয়া বিরাট গৰ্হিত কাজ হয়েছে। হিসাবে ভুল করেছেন।
এককড়ি হতাশ গলায় বললেন, আমি কী ভুল করলাম! মসজিদ আমি জ্বালায়ে দিব কোন দুঃখে?
দারোগা সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে গোফে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আমাদের কাছে খবর আছে। থানাওয়ালাদের খুশি করার ব্যবস্থা করেন, দেখি কী করা যায়। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ হয়ে হিসাবে কীভাবে ভুল করলেন বুঝলাম না।
এককড়ি থানাওয়ালাদের খুশি করার জন্যে পাঁচশ’ টাকা দিলেন।
দারোগা সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন, এই টাকা তো এসপি সাহেবকেই পাঠায়ে দিতে হবে। লালমুখ ইংরেজ সাহেব। পাঁচশ’ টাকা হাজার টাকা ছাড়া তাদের সামনেই যাওয়া যায় না।
এককড়ি আরো পাঁচশ’ দিলেন।
ঘটনা এইখানেই শেষ হবে বলে এককড়ির মনে হচ্ছে না। থানাওয়ালারা র্তীতের মাকুর মতো আসা-যাওয়া করতেই থাকবে। প্রতিবারই তাদের খুশি করতে হবে।
এককড়ি হাতজোড় অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছেন। মন কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছেন। রাধাকৃষ্ণকে একমনে কিছুক্ষণ ডাকতে হবে। প্রথমে শ্ৰীকৃষ্ণ স্তব, তারপর শ্ৰীরাধিকা স্তব পাঠ করতে হবে। অবিনাশ ঠাকুর দুটি স্তবই লিখে দিয়ে গেছেন। শ্ৰীকৃষ্ণের স্তব মুখস্থ হয়েছে। শ্ৰীরাধিকারটা এখনো হয় নি। এককড়ি স্তব শুরু করলেন–
রক্ষ রক্ষ হরে মাং চ নিমগ্নং কামসাগরে
দুষ্কীৰ্ত্তিজল পূর্ণে চ দুষ্পারে বহু সংকটে
ভক্তি বিস্মৃতি বীজে চ বিপৎ সোপানদুস্তরে
অতীব নির্মল জ্ঞান চক্ষুঃ প্রচ্ছন্নকারিনে…