মাওলানা জ্বরের সময় তাঁর অভিজজ্ঞতার কথা এই জ্ঞানী মানুষকে বলেছেন। বিভূতিভূষণ বলেছেন, মৃত্যুর আগে আগে সমস্ত মানুষকেই তার মৃত্যুসংবাদ দেয়া হয়। কেউ বুঝতে পারে, কেউ বুঝতে পারে না।
ইদরিস বললেন, এটা কি মৃত্যুসংবাদ?
বিভূতিভূষণ বললেন, হতে পারে। তবে আপনি ভয় পাবেন না। মৃত্যুর পরের জগৎ অতি আনন্দময়। সেই আনন্দ যে কী তা আমাদের ধারণা করা সম্ভব না।
শুধুই আনন্দ? দুঃখ নাই?
আমার মনে হয় নাই। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদের কষ্ট দেবেন তা আমি মনে করি না। মৃত্যুর পর তিনি আমাদের তীর জগৎ, তাঁর সৃষ্টিরহস্য দেখার সুযোগ করে দেবেন। পরকাল নিয়ে আমার একটা লেখা আছে। নাম ‘দেবযানী’। আপনি কি পড়তে চান?
ইদরিস বললেন, জি-না জনাব। গল্পকাহিনী আমার ভালো লাগে না। কাছাছুল আম্বিয়ার কাহিনী ভালো লাগে। অন্যকিছু ভালো লাগে না।
যমুনার কাছে ‘দেবযানী’ বইটা আছে। যদি পড়তে ইচ্ছা করে পড়বেন।
জি আচ্ছা জনাব। তবে পড়তে ইচ্ছা করবে না।
বিভূতিভূষণ হেসে ফেললেন। *
————-
* এই মহান ঔপন্যাসিক বান্ধবপুর এসেছিলেন। যথাসময়ে সেই গল্প করব। সেপ্টেম্বরের এক তারিখ ১৯৫১ সনে তিনি মারা যান। মৃত্যুর তিনদিন আগে তাঁর ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন সন্ধ্যাকাল। তিনি বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ দেখলেন একদল শ্মশানযাত্রী শব নিয়ে যাচ্ছে। তিনি কৌতূহলী হয়ে তাকালেন এবং অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, যে শব নিয়ে যাচ্ছে সে আর কেউ না। তিনি নিজে। বিভূতিভূষণ এই দৃশ্য দেখেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তৃতীয়দিনের দিন মারা গেলেন।
আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি
আষাঢ় মাসের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাওলানা ইদরিস গ্রামে ফিরছেন। তাঁর মন বিষণ্ণ। বাড়ি ফেরার আনন্দ পাচ্ছেন না। যে কাজে বের হয়েছিলেন তা শেষ করতে পারেন নি। শশাংক পালের মেয়ে ললিতার খোঁজ বের করতে পারেন নি। যমুনা তাঁকে বগুড়া যেতে দেয় নি, তবে নিজে লোক পাঠিয়েছিল। সেই লোক বিফল হয়ে ফিরেছে।
ইদরিস লঞ্চঘাটায় নেমে হাঁটতে শুরু করেছেন। বৃষ্টি পড়ছে বলেই তাকে কেউ সেভাবে লক্ষ করছে না। তিনি তাতে খুব স্বস্তি বোধ করছেন। সারাজীবন পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি পরেছেন। আজ তার পরনে হাফ হাতা, সাইড পকেটওয়ালা নীল রঙের সার্ট। কালো প্যান্ট। যমুনা তাকে একজোড়া চামড়ার কাবলি স্যান্ডেল কিনে দিয়েছে। কাদার মধ্যে বারবার স্যান্ডেল আটকে যাচ্ছে।
ইদরিসের মাথায় কংগ্রেসি টুপি। যমুনার স্বামী সুরেন এই টুপি তাকে পরিয়ে দিয়েছে। টুপির রঙ কটকট হলুদ। একজন আগ্রহ করে নিজে মাথায় পরিয়ে দিয়েছে বলে খুলতেও পারছেন না। মাথার টুপি হবে সাদা কিংবা কালো। ইদরিসের হাতে গান্ধিজির লাঠির মতো একটা লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে তিনি লাবুসের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কেউ তাকে চিনতে পারে নি।
মীরা পুকুরঘাটে খেলছিল। পুকুরঘাটে আসা তার নিষেধ। আজ বাড়িতে কেউ নেই বলে সে চলে এসেছে। কয়লা দিয়ে ঘর কেটে এক্কাদোক্কা খেলছে। এই খেলাটা একটু অন্যরকম। চাড়া ফেলার সময় সুর করে ছড়া পড়তে হয়—
আমি সতী ভাগ্যবতী
আমি যাব স্বামীর বাড়ি
আমার স্বামীর নাই ঘর
আমারে নিয়া রওনা কর।
‘আমারে নিয়া রওনা কর’ বলেই চোখ বন্ধ করে উল্টোদিক ফিরে চাড়া ফেলতে হয়। মীরা তাই করল। তার অনুমানে ভুল হলো। চাড়া গিয়ে পড়ল পুকুরে। চাড়াটা পানিতে ভাসছে। মীরা একধাপ পানিতে নামলেই চাড়া হাতে পাবে। সে সাবধানে একধাপ নিচে নামল। পানিতে ঢেউ ওঠায় চাড়া সামান্য সরে গেছে। তাকে আরো একধাপ নামতে হবে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। চাড়াটা তার পছন্দের। মীরা যখন ঠিক করল সে আরো একধাপ নামবে তখনি মাওলানা ইদরিস কাদায় মাখামাখি হওয়া পা ধুতে পুকুরঘাটে এলেন। মীরা তার দিকে তাকিয়ে টনটনে পরিষ্কার গলায় বলল, বাবা, তোমার দাড়ি গেল কই?
মেয়ে রাম বলছে না। টর টর করে পরিষ্কার কথা বলছে। ইদরিসকে হতভম্ব করে মীরা বলল, বাবা, তোমার হাতের লাঠি কি সাপমারা লাঠি? বাড়িতে হাদিস চাচা একটা সাপ মেরেছে, এক হাজার হাত লম্বা।
মাওলানা মেয়ের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। শিয়ালদা রেলষ্টেশনে যখন পড়ে ছিলেন তখন এই মেয়ের সঙ্গে যে আবার দেখা হবে তিনি কল্পনাও করেন নি। একসময় আল্লাহপাককে ডেকে বলেওছিলেন, হে গাফুরুর রহিম! মেয়েটাকে তোমার হাতে সোপর্দ করলাম।
মীরা বলল, বাবা, কাঁদো কেন?
ইদরিস জবাব না দিয়ে পুকুরঘাটে শোকরানা নামাজ পড়ার জন্যে অজু করতে বসলেন। আল্লাহপাকের কাছে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। যদিও বান্দার কৃতজ্ঞতায় বা অকৃতজ্ঞতায় তাঁর কিছুই যায় আসে না।
মীরা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছে। মাঝে মাঝে চাড়াটার দিকে তাকাচ্ছে। চাড়াটা বাতাস পেয়ে এখন তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে মনে হয়। আরেক ধাপ নিচে নামতে হবে না।
নামাজ শেষ করেই মাওলানা কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে কাগজ এবং কয়লা বের করলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। পুকুরঘাটেই এখন কাক আঁকা যাবে। মেয়েটাকে মুগ্ধ করতে হবে।
মীরা চোখ বড় বড় করে বাবার কাণ্ড দেখছে।
কী কর বাবা?
তাকায়া থাক। দেখ কী করি।
চিঠি লেখা?
হুঁ।
কারে চিঠি লেখা?
ইদরিসের কাক আঁকা শেষ হয়েছে। তিনি কাগজটা মেয়ের সামনে ধরলেন। মীরা চিৎকার দিয়ে বলল, ও আল্লা, কাউয়া!