ধনু শেখ ভীত গলায় বলল, চিনি।
উইপোকার পাখা কেন উঠে জানো?
উড়াল দিবার জন্যে।
না। উইপোকার পাখা উঠে মরিবার তরে। তুমি উইপোকা ছাড়া কিছু না। তোমার পাখা উঠেছে। তুমি সবেরে জাইত পাইত শিখাইতেছ?
ধনু শেখ বলল, কর্তা ভুল হইছে।
ভুল স্বীকার পাইলে কানো ধরা। কানে ধইরা একশ’বার উঠবোস করা।
ধনু দেরি করল না। কানে ধরে উঠবোস শুরু করল। সে ধরেই নিয়েছিল চাকরি চলে যাবে। কানে ধরে উঠবোসের মতো অল্প শাস্তিতে পার পেয়ে যাচ্ছে দেখে সে আনন্দ। তার হাঁটুতে ব্যথা, উঠবোস করতে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট কোনো কষ্টই না।
নিবারণ চক্রবর্তী খাতা দেখছিলেন। খাতা থেকে মাথা তুলে বললেন, একশ’বার কি হইছে?
জে কর্তা হইছে।
এখন বিদায় হও। তোমার চাকরি শেষ। লঞ্চঘাটায় নতুন টিকেট বাবু যাবে। আইজ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়বা। নতুন টিকেট বাবু পরিবার নিয়া উঠবে।
আমার চাকরি শেষ?
এতক্ষণ কী বললাম?
ধনু শেখ বলল, চাকরি। যদি শেষই করবেন কান ধইরা উঠবোস করাইলেন। কী জন্যে?
নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, আগেই যদি বলতাম চাকরি শেষ তাহলে কি কানে ধরে উঠবোস করতা? এই জন্যে আগে বলি নাই।
ধনু শেখ বলল, এইটা আপনের ভালো বিবেচনা।
তোমার ছয়দিনের বেতন পাওনা আছে। নতুন টিকেট বাবুর কাছে থাইকা নিয়া নিবা। তার নাম পরিমল। যাও, এখন বিদায়। জটিল হিসাবের মধ্যে আছি।
ধনু শেখ অতি দ্রুত গভীর জলে পড়ে গেল। স্ত্রীকে নিয়ে উঠার কোনো জায়গা নেই। নিজের খরুচে স্বভাবের কারণে সঞ্চয়ও নেই।
সে কিছুদিন বাজে মালের দোকান চালাবার চেষ্টা করল। স্ত্রীর জায়গা হলো নৌকায়। ছাইওয়ালা নৌকার দু’পাশ শাড়ি দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে সংসার।
ধনু শেখের দোকান চলল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ তার দোকান থেকে কিছু কেনে না। আশ্চর্যের ব্যাপার, মুসলমানওরাও না। রাতে নৌকায় ঘুমাতে গিয়ে ধনু শেখ হতাশ গলায় বলে, বউ কী করি বলো তো।
নতুন কোনো ব্যবসা দেখবেন?
কী ব্যবসা?
ঘোড়াতে কইরা ধর্মপাশা থাইকা মাল আনবেন।
এই ব্যবসা করব না বউ। যারা ঘোড়ার মাল টানাটানি করে তারার স্বভাব হয় ঘোড়ার মতো। ঘোড়া হওয়ার ইচ্ছা নাই।
নিবারণ চক্রবর্তীর কাছে গিয়া তার পায়ে উপুড় হইয়া পইড়া দেখবেন। পুরান চাকরি যদি ফেরত পান।
ধনু শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, লাভ নাই। উনার নতুন টিকেট বাবু কাজ ভালো জানে। তার জায়গায় আমারে দিবে না।
এখন উপায়?
তাই ভাবতেছি।
অতিদ্রুত অবস্থা এমন পর্যায়ে গেল যে চাল ডাল কেনার টাকায় টান পড়ল। এর মধ্যে আরেক বিপদ কমলা গৰ্ভবতী। তার সারাক্ষণ ভুখ লাগে। এটা সেটা খেতে ইচ্ছা করে। একদিন অর্ধেকটা মিষ্টি কুমড়া কাঁচা খেয়ে ফেলল।
ধনু শেখ বলল, বৌ, তোমারে তোমার মায়ের কাছে পাঠায়া দেই?
কমলা বলল, আপনেরে এতবড় বিপদে ফেইলা আমি বেহেশতেও যাব না। তাছাড়া আমার মা’র নিজেরই খাওন জুটে না। আমার কাছে স্বর্ণের একটা চেইন আছে। এইটা বিক্রি করেন।
ধনু শেখ স্বর্ণের চেইন বিক্রি করতে পারল না। বাজারের একমাত্র স্বর্ণকারের দোকানের মালিক শ্ৰীধর বলল, এর মধ্যে সোনা বলতে কিছু নাই। সবই ক্ষয়া গেছে।
ধনু শেখ বলল, কর্তা! না খায়া আছি। স্ত্রীর সন্তান হবে।
শ্ৰী ধর বলল, তোমার সাথে বাণিজ্য করব না। তুমি জাত নিয়া অন্দ মন্দ কথা বলো। তোমার সাথে বাণিজ্য করলে শ্ৰী গণেশ বোজার হবেন। দোকান লাটে উঠব। আমিও তোমার মতো না খায়া থাকব।
বন্দক রাইখা কিছু দেন।
বন্দক রাখতে হয়। ভগবানের নামে, তোমার আবার ভগবান কী?
ধনু শেখ বলল, তাও তো কথা।
ভাদ্র মাসের একদিন ধনু শেখকে সত্যি সত্যি উপাসে যেতে হলো। সারাদিনে দুই মুঠ চিড়া ছাড়া খাওয়ার নেই। তাও ভালো কমলা খেতে পেরেছে। চাল যা ছিল তাতে একজনের মতো ভাত হয়েছে। ফ্যান ভাতে লবণ ছিটিয়ে কমলা এত আগ্রহ করে খেল যে ধনু শেখের চোখে পানি এসে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল, বউ, একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছি?
কমলা আগ্রহ নিয়ে বলল, কী সিদ্ধান্ত?
ডাকাতি করব। ডাকাতি বিনা পথ নাই।
কমলা হাসতে শুরু করেই হাসি বন্ধ করে ফেলল। ধনু শেখের মুখ গম্ভীর। চোখ জ্বল জ্বল করছে।
ডাকাতি করবেন?
হুঁ।
ডাকাইতের দল থাকে। আপনের দল কই?
দল লাগে না।
কমলা বলল, আমার সন্তানের কসম দিয়া একটা কথা বলি।
ধনু শেখ কিছু বলল না।
আপনি সত্যই ডাকাতি করবেন?
হুঁ।
এই সময় ঘাট থেকে কেউ একজন ডাকল, এটা কি ধনু শেখের নাও?
ধনু নৌকা থেকে বের হয়ে দেখে হরিচরণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ধনু বলল, বাবু আদাব।
আদাব। তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে আসছি। নায়ে উঠি?
উঠেন। আমার সাথে কী গফ করবেন? আমি একজন ছলু। জুতার শুকতলি।
হরিচরণ নৌকায় উঠলেন। ধনু শেখ পাটাতনে গামছা বিছিয়ে দিল। হরিচরণ বসতে বসতে বললেন, কুকুরের বাচ্চা এবং মানুষের বাচ্চা নিয়া তুমি যে এক মীমাংসা দিয়েছ, মীমাংসাটা আমার মনে লেগেছে।
মীমাংসার উত্তর কি আপনের কাছে আছে?
আছে।
বলেন শুনি।
হরিচরণ বললেন, মানুষের তুলনা মানুষের সাথে হবে। অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে হবে না। একটা মন্দ মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মন্দ মানুষের বিবেচনা হবে। কোনো মন্দ প্রাণীর সঙ্গে হবে না। বুঝেছ?
বোঝার চেষ্টা নিতেছি।
হরিচরণ বললেন, আরো একটা কথা আছে।
বলেন শুনি।
মানুষের তুলনায় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী তুচ্ছের তুচ্ছের তুচ্ছ। ধুলিকনার চেয়েও তুচ্ছ। ধুলিকন গায়ে তুললেও কিছু না, গা থেকে ফেলে দিলেও কিছু क†।