আপনি বলেছেন।
মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক প্রভেদ আছে। প্ৰভেদ হলো অমিল। অমিলগুলো কি জানো? –
না।
ভেবে ভেবে বলো। চিন্তা করে বলে।
গাছ কথা বলতে পারে না।
হয়েছে। আর কী?
গাছ হাঁটতে পারে না।
হয়েছে। আর কী?
জানি না।
চিন্তা করে বলো। কখনো হুট করে ‘জানি না’ বলবে না। চিন্তা করো।
ছেলেটা গম্ভীর ভঙ্গিতে গালে হাত দিয়ে চিন্তা করে। দেখতে এত ভালো লাগে! আচ্ছা জন্মান্তর কি আছে? এমন কি হতে পারে তাঁর মৃত কন্যা মুসলমান ঘরে পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়েছে? তার মেয়ের মাথায় চুল ছিল কোঁকড়ানো। এই ছেলেরও তাই। আগের জন্মে মেয়েটা পানিতে ড়ুবে মরেছিল। এই জন্মেও একটা ঘটনা ঘটেছে, তবে এই জন্মে সে রক্ষা পেয়েছে।
মাঝে মাঝে হাটের দিন যখন সুলেমান হাটে যায়, জুলেখা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তার হাতে থাকে শলার ঝাড়ু। ছেলের হাতেও থাকে ঝাড়ু। দু’জনে বিপুল উৎসাহে বাড়িঘর ঝাঁট দিতে থাকে। ঘর পরিষ্কার পর্ব শেষ হলো জুলেখা খিচুড়ি রাধতে বসে। হরিচরণ তখন পাশেই থাকেন। রান্না দেখেন। রান্নার সময় জুলেখা নানান গল্প করে।
জগতের সবচে’ সহজ রান্ধন খিচুড়ি। হাতের কাছে যা আছে সব হাড়িতে দিয়া জ্বল। একটু নুন, দুই একটা কাঁচামরিচ। ব্যস।
ছেলে প্রশ্ন করে, জগতের সবচে’ কঠিন রান্ধন কী?
ভাত। ঝরঝরা নরম ভাত রান্ধা বড়ই কঠিন। একটু জ্বল বেশি হইলে ভাত গলগলা। জ্বাল কম ভাত শক্ত চাউল।
কোনো কোনো দিন জুলেখা তার বাবার গল্প শুরু করে। কবে কোনদিন তার ব্যাপজান কবিগানের প্রশ্নোত্তরে বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন—তার গল্প। এই সময় জুলেখার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। হরিচরণের মনে হয়, মেয়েটার মুখ থেকে আলো বের হচ্ছে।
বুঝলেন বাবা! জাঙ্গির আলী, সেও বিরাট নামি মালজোড়ার গায়েন, আমার বাপজানরে কঠিন একখান সোয়াল করল— মাটি ক্যামনে সৃষ্টি হইল?
বাপজান সঙ্গে সঙ্গে বলল, (জুলেখা এই অংশে গান শুরু করল)
ওরে গুন ধান!
প্রশ্নের কী বিবরণ! সভার মাঝে করিব বর্ণন।
ধৈর্য ধরে শুনো ওরে শ্রোতাবন্ধুগণ।
দুই দিনে হয় মাটির জনম
চারদিনে আল্লাহ সব করিলেন সৃজন।
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, হঠাৎ হঠাৎ অম্বিকাচরণ উপস্থিত হন। তিনি প্রতিবারই সমাজ থেকে পতিত হবার পর উদ্ধারের একেকটা উপায় নিয়ে আসেন। পুকুরঘাটে বসে গলা উঁচিয়ে ডাকেন- হরি! আছো? খোজ নিতে আসলাম। আছো কেমন?
ভালো আছি।
তোমার উপর কাজটা অন্যায্য হয়েছে। আমি খোজ নিয়েছি, একটা সোনার চামচে গোবর নিয়া চামচের হাতলে তিনবার দাঁতে কামড় দিলেই শরীর শুদ্ধ হয়। তারপর সেই চামচ কোনো এক সৎ ব্রাহ্মণকে দান করে দিতে হয়। কাশির এক পণ্ডিতের বিধান।
কেমন পণ্ডিত?
বিরাট পণ্ডিত। চার-পাঁচটা ন্যায়রত্ব রামনিধি পানিতে গুলে খেয়ে ফেলতে পারে। তোমার শরীর শুদ্ধির ব্যবস্থা কি করব?
যাক আরো কিছু দিন। তাছাড়া আপনি শরীর শুদ্ধি করলে তো হবে না। কেউ মানবে না। কাশির পণ্ডিতদের লাগবে।
তাও কথা। একটা কাজ করি, কোনো শুভদিন দেখে দু’জনে কাশি চলে যাই। তোমার তো অর্থের অভাব নাই। আমারে খরচ দিয়া নিয়া গেলা। পুণ্যধাম কাশি কোনোদিন দেখি নাই। দেখার শখ আছে।
নিয়ে যাব আপনাকে। কথা দিলাম। আমি উদ্ধার পাই বা না পাই— আপনার শখ মেটাব।
অম্বিকাচরণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন, হরিচরণের জন্যে তার সত্যি খারাপ লাগে।
হরিচরণের জন্যে আরেকজন মানুষের খুবই খারাপ লাগে, তার নাম ধনু শেখ। সে লঞ্চঘাটের টিকেট বাবু। মাঝে মাঝে টুকটাক ব্যবসা করে। কোলকাতা থেকে এক ড্রাম লাল কেরোসিন নিয়ে এসে বান্ধবপুরে বিক্রি করে। লঞ্চে পাঠিয়ে দেয় শুকনা মরিচ। এতে বাড়তি আয় যা হয় তা সে ব্যয় করে নতুন বিয়ে করা স্ত্রীর পেছনে। পাউডার, স্নো, শাড়ি, রুপার গয়না। লঞ্চঘাটের কাছেই টিনের এক চালায় তার সংসার। স্ত্রীর নাম কমলা। ধনু শেখ স্ত্রীর খুবই ভক্ত। তার একমাত্র স্বপ্ন একদিন সে একটা লঞ্চ কিনবে। সেই লঞ্চ নারায়ণগঞ্জ সোহাগগঞ্জ চলাচল করবে। লঞ্চের নাম এমএল কমলা। এমএল হলো মোটর লঞ্চ। সেই লঞ্চে কমলা নামের যে-কোনো যাত্রী যদি উঠে সে যাবে ফ্রি। তার টিকেট লাগবে না।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ লঞ্চের টিকেট কাটতে এলেই ধনু শেখ কোনো না কোনো প্রসঙ্গ তুলে হরিচরণের জাত নষ্টের কথা তুলবে।
বাবু, আপনে বলেন- মনে করেন সুন্দর একটা কুত্তার বাচ্চা রাস্তায় হাঁটতেছে। আপনে ‘আয় তু তু’ বললেন, সে লাফ দিয়া আপনের কোলে উঠল। আপনের জাইত কিন্তু গেল না। মুসলমানের এক বাচ্চা কোলে নিছেন— জাইত গেল। এখন মীমাংসা দেন— মুসলমানের বাচ্চা কি কুত্তার চাইতে অধম?
যে সব বাবুদের এ ধরনের প্রশ্ন করা হয় তারা বিব্রত হন না। বিরক্ত হন। কেউ কেউ বলেন, তুমি টিকেট বাবু। তুমি টিকেট বেচবা। এত কথা কী?
জাইত জিনিসটা কী বুঝায় বলেন। শরীরের কোন জায়গায় এই জিনিস থাকে, ক্যামনে যায়? জিনিসটা কি ধুয়াশা?
তুমি বড়ই বেয়াদব। তোমার মালিকের কাছে বিচার দিব। চাকরি চাইলে। যাবে। না খায়া মরবা।
মরলে মরব। তয় জাইতের মীমাংসা কইরা দিয়া মরব।
তুমি জাইতের মীমাংসা করার কে? জাইতের তুমি কী বুঝ?
আমি না বুঝলেও আপনেরা তো বোঝেন। আপনেরা মীমাংসা দেন।
বেয়াদবির কারণেই, ধনু শেখের টিকেট বাবুর চাকরি চলে গেল। লঞ্চ কোম্পানির মালিক নিবারণ চক্রবর্তী তাকে ধর্মপাশা অফিসে ডেকে পাঠালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ধনু, উইপোকা চেন?