হরিচরণ বললেন, এত বড় হাতি আর তুমি ছোটখাটো মানুষ। তোমার কথা কি মানে?
কালুমিয়া বলল, জে কর্তা, মানে। আমি তার চোখের সামনে থাকলেই সে ঠাণ্ডা থাকে। চোখের আড়াল হলেই অস্থির হয়।
এত বড় জন্তু বশ করলে কীভাবে?
আদর দিয়ে। সব পশু আদর বুঝে। মানুষের চেয়ে বেশি বুঝে।
মানুষ কম বুঝে?
জে। কর্তা।
মানুষ কম বুঝে কেন?
মানুষরে আদর করলে মানুষ ভাবে আদরের পেছনে স্বাৰ্থ আছে। পশু স্বার্থ বুঝে না।
কালু মিয়া! আমি যদি হাতিটাকে আদর করি সে বুঝবে?
অবশ্যই বুঝবে। হাতির অনেক বুদ্ধি। আর হাতি আদরের কাঙ্গাল।
হরিচরণ হাতির গায়ে হাত রাখলেন। হাতি মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখল। হরিচরণ বললেন, কেমন আছিস গো বেটি?
হাতি শুড় ঝাকালো।
হরিচরণ বললেন, তুই আমার বাড়ির অতিথি। তুই কী খেতে চাস বল।
কালু মিয়া বলল, কর্তা, আপনের প্রত্যেকটা কথাই হে বুঝছে। জবান নাই বইলা উত্তর দিতেছে না।
হরিচরণ বললেন, তোমার হাতি কী খেতে সবচে’ পছন্দ করে বলো। আমি তাই খাওয়াব।
এক ধামা আলুচাল দেন। এক ছড়ি কলা দেন, আর নারকেল দেন। আপনি নিজের হাতে তারে খাওয়াটা দিবেন, বাকি জীবন সে আপনারে ভুলবে না।
হরিচরণ নিজের হাতে হাতিকে খাবার খাওয়ালেন। কালু মিয়া বলল, কর্তা, আপনার আদর হে বেবাকটাই বুঝছে।
তুমি জানলে কীভাবে?
দেহেন না একটু পর পর শুঁড় দিয়া আপনেরে ধাক্কা দিতাছে। এইটা তার খেলা। পছন্দের মানুষের সাথে এই খেলা সে খেলে।
অল্প কয়েক ঘণ্টায় হাতিটার উপর তার অস্বাভাবিক মায়া পড়ে গেল। তৃতীয় দিনে সেই মায়া যখন অনেক গুণ বেড়েছে, তখনি হাতি ফেরত নেবার জন্যে শশাংক পালের দুই ম্যানেজার উপস্থিত। তারা টাকা নিয়ে আসে নি, এসেছে খালি হাতে।
তাদের কাছেই হরিচরণ জানলেন যে, হাতি বন্ধক রেখে টাকা নেবার কোনো ঘটনা ঘটে নি। বন্ধক নামায় যে টিপসই আছে সেটা শশাংক পালের না। তিনি যদি ইচ্ছা করেন বন্ধকনামা নিয়ে কোর্টে যেতে পারেন।
হরিচরণ বললেন, হাতি নিয়ে যাও।
কালু মিয়ার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সে হরিচণের পা ছুঁয়ে বিদায় নিল।
হরিচরণ তাকে রুপার একটা টাকা দিয়ে বললেন, তোমার স্বভাব আচারআচরণ আমার পছন্দ হয়েছে। হাতির সঙ্গে থাক বলেই হাতির স্বভাব তোমার মধ্যে এসেছে। হাতি উত্তম প্রাণী। তুমিও উত্তম।
শশাংক পাল হাতি ফিরিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি হরিচরণের উপর নানাবিধ নির্যাতনের চেষ্টা করলেন। সমাজচ্যুতির বিষয়টা পাকাপাকি করলেন। তার ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়ে গেল। সোহাগগঞ্জে পাটের গদিতে আগুন লোগে। সব পুড়ে গেল। কিছু বিশ্বাসী কর্মচারী তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। হরিচরণ দমলেন না। নাপিত বন্ধ হওয়ার কারণে তিনি চুল-দাড়ি কাটা বন্ধ করলেন। তার মাথাভর্তি চুল-দাড়ি গজল। চেহারা ঋষি ঋষি হয়ে গেল।
মানুষ এমন প্রাণী যে দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। হরিচরণ একা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সকালে গাদিতে বসেন। ব্যবসার কাজকর্ম দেখেন। গদির হিন্দু কর্মচারীদের জাতের সমস্যা হয় নি। তারা আগের মতোই আছে। তাদের দুপুরের খাবার সময় হলেই কিছু সমস্যা হয়। তখন হরিচরণকে গদিঘর থেকে চলে আসতে হয়। তিনি নিজের বাড়িতে রান্না করতে বসেন। ভাত, আলু সেদ্ধ, ঘি। কোনো কোনো দিন। ডিম। খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ির আশেপাশে হাঁটতে বের হন। দেখাশোনার কেউ না থাকায় বাড়ির চারদিকে ঘন জঙ্গল হয়েছে। ঘাস এবং কচুবনে বাড়ি প্রায় ঢাকা পড়ার মতো অবস্থা। কোনো একদিন মনে হয় বাড়ি পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাবে। সেটাও মন্দ কী! বনের ভেতর হাঁটতে গিয়ে মাঝে মাঝে চমকে যাবার মতো ঘটনাও ঘটে। ঘটনাগুলো নিয়ে তার ভাবতে ভালো লাগে। একবার হিজল গাছের গোড়ায় কয়েকটা সাপের ডিম দেখলেন। আকাশী নীল রঙের ডিম। মাঝে মাঝে হলুদ ছোপ। দেখে মনে হয়, রঙ-তুলি দিয়ে কেউ ডিমগুলো এঁকেছে। সাপের মতো ভয়ঙ্কর একটা প্রাণীর ডিম এত সুন্দর কেন এই বিষয় নিয়ে ভেবে ভেবে অনেক সময় পার করলেন। ক্লোলকাতায় চিঠি পাঠালেন সাপের উপর বই বুকপোস্টে পাঠানোর জন্যে।
বই পড়ার অভ্যাস তার ছিল না। এই অভ্যাস ভালোমতোই হলো। বেশির ভাগই ধর্মের বই, সাধুদের জীবনকাহিনী। পাশাপাশি ইতিহাসের বই। সন্ধ্যার পর তার প্রধান কাজ— হারিকেন জ্বলিয়ে বই পড়া। সুর করে কাশীদাসীর মহাভারত পড়তেও তার ভালো লাগে। তার মনে হয়। রামায়ণ পাঠের সময় দেহধারী না এমন অনেকেই চারপাশে জড়ো হয়। তারা নিঃশব্দে মন দিয়ে পাঠ শোনে—
হেতায় ভাবিত রাজা আশ্রমে বসিয়া।
ধীরে ধীরে কহিলেন অৰ্জ্জুনে চাহিয়া।।
শুন ভাই ধনঞ্জয়, না বুঝি কারণ।
ভীমের বিলম্ব কেন হয় এতক্ষণ।।
শীঘ্ৰগতি বৃকোদরে কর অন্বেষণ।
বুঝি ভীম কারো সনে করিতেছে রণ।।
জহির ছেলেটা প্রায়ই আসে। তার প্রধান ঝোক পুকুরের পানি। হরিচরণ তাকে সাঁতার শেখালেন। এই কাজটা করেও খুব আনন্দ পেলেন।
নিঃসঙ্গ জীবনে বনে-জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে জহিরের সঙ্গে গল্প করা তার জন্যে আনন্দময় অভিজ্ঞতা। ছেলেটা অতিরিক্ত বুদ্ধিমান। বড় হলে তার এই বুদ্ধি থাকবে কি-না এটা নিয়েও হরিচরণ চিন্তা করেন। ছেলেটার সঙ্গে জ্ঞানের কথা বলতেও হরিচরণের ভালো লাগে। কারণ এই ছেলে কথাগুলো বুঝতে পারে।
জহির!
হুঁ।
মানুষের যেমন জীবন আছে গাছেরও আছে— এটা জানো?
জানি।
কীভাবে জানো?