এটাতো খুব সহজ খেলা বাবা।
মোটেই সহজ না। খুব কঠিন খেলা। কারণ মানুষ বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে পারে না। পর পর দশটা মিথ্যা বলা মানুষের জন্যে খুব কঠিন। বেশির ভাগ মানুষই পারে না।
আমি পারব?
না তুমিও পারবে না। এসো শুরু করা যাক। রেডি-ওয়ান টু খ্ৰী— খোকা তোমার নাম কি— টগর?
জ্বি না। আমার নাম টগর না।
তোমার ছোট একটা বোন আছে না?
জ্বি না। আমার একটা ভাই আছে।
তুমি কি ক্লাস থ্রিতে পড়?
জ্বি না। আমি ক্লাস টেনে পড়ি।
তোমার কি তিনটা হাত আছে?
হ্যাঁ আমার তিনটা হাত আছে?
তুমি কি তোমার মা-কে খুব ভালবাস?
হ্যাঁ বাসি।
আনিস হেসে ফেলল। টগর মাথা নিচু করে ফেলেছে। আনিস বলল, দেখলে তো টগর, মাত্র পাঁচটা প্রশ্নেই তুমি সত্যি কথা বলে ফেললে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলা খুবই কঠিন।
টগর চাপা গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলা কঠিন কেন বাবা?
কঠিন, কারণ মানুষকে মিথ্যা কথা বলার জন্য তৈরি করা হয়নি। তবু আমরা মিথ্যা কথা বলি। যখন বলি তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়।
আমার তো কষ্ট হয় না। বাবা।
তুমি কি মিথ্যা কথা বল?
হ্যাঁ বলি। স্কুলে বলি।
আনিস উপদেশমূলক কিছু বলবে কি বলবে না। এই নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলা। শৈশবে নীতিকথার আসলে কি কোন গুরুত্ব আছে? একই পরিবারের চারটি ছেলেমেয়ে শৈশবে একই ধরনের নীতিকথা এবং উপদেশ শোনে কিন্তু বড় হয়ে চারজন চার রকমের হয়। আনিসের ধারণা শিশুরা বইয়ের উপদেশ গ্ৰহণ করে না। একটি শিশু অন্য একটি শিশুর কথা শুনে কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের কথা শুনে না। তাদের জগৎ ভিন্ন, তারা নিজেদের জগৎ থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে।
টগর।
টগর জবাব দিল না। আনিস দেখল, টগর ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নিজের চোেখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে কিন্তু সে জানে বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম চলে যাবে। নানান উদ্ভট চিন্তা মাথায় ভর করবে। তারপর আসবে সুখময় কিছু কল্পনা। সেই কল্পনায় চব্বিশ বছর বয়েসী একজন তরুণী এসে ঘরে ঢুকবে। পান খাওয়ায় সেই তরুণীর ঠোঁট লাল হয়ে আছে। তরুণীটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টলমলে চোখে স্নিগ্ধ ছায়া।
আনিস বিরক্ত হবার মত ভঙ্গি করে বলবে, আবার পান খেয়েছ?
তরুণীটি বলবে, হ্যাঁ খেয়েছি।
দাঁতগুলি নষ্ট করবে।
করলে করব। সারা দিনে একবার পান খাই তাতেই–
আচ্ছা যাও আর কিছু বলব না।
তোমার কি চা লাগবে?
হ্যাঁ।
ঘুমুতে যাবার আগে কেউ চা খায় এই প্রথম দেখলাম।
ঘুমুতে যাব তোমাকে কে বলল?
ঘুমুবে না?
নো ম্যাডাম। সারা রাত জাগব।
লেখালেখি? হ্যাঁ লেখালেখি। নতুন উপন্যাস শুরু করছি।
তুমি না বললে সোমবার থেকে শুরু করবে।
দুদিন আগেই শুরু করছি।
উপন্যাসের নাম কি?
ময়ূরাক্ষী। নামটা কেমন?
সত্যি জানতে চাও।
হ্যাঁ।
বললে রাগ করবে নাতো?
না–এর মধ্যে রাগ করার কি আছে?
নিউ এলিফেন্ট রোডের একটা জুতার দোকানের নাম ময়ূরাক্ষী।
আনিস তাকিয়ে আছে। তরুণী খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু সে হাসছে। কি অসাধারণ একটি দৃশ্য চমৎকার দৃশ্য তার জীবনে অভিনীত হয়েছে এই কথাটা আজ আর কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আজ মনে হয় রাত্ৰি নামে কোন তরুণীর সঙ্গে তার কোনদিন পরিচয় ছিল না। সবই কল্পনা সবই মায়া।
সোবাহান সাহেব
বাহান সাহেবের সামনে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে সোবাহান সাহেব তাকে চিনতে পারলেন না। মাঝারি গড়নের একজন যুবক। গায়ে খন্দরের পাঞ্জাবী, চোখে মোটা কাচের চশমা। মুখ হাসি হাসি। গেট খুলে তরতর করে এগিয়ে
এসেছে। যেন বাড়ি ঘর খুব পরিচিত। অনেকবার এসেছে।
স্লামালিকুম। ওয়ালাইকুম সালাম।
আমার নাম আনিস। আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?
আমি কি আপনাকে চিনি?
জ্বি না। অচেনা লোকের সঙ্গে কি আপনি কথা বলেন না?
সোবাহান সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। এই যুবকের মতলব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেশ ভর্তি হয়ে গেছে। মতলববাজ যুবক। এদের কোন রকম প্রশ্ৰয় দেয়া উচিত না।
স্যার, আমি কি বসব?
দীর্ঘ আলাপ থাকলে বসুন। আর সংক্ষিপ্ত কোন কিছু বলার থাকলে বলে চলে যান।
আনিস বসল। তার কাঁধে একটা ভারী হ্যান্ডব্যাগ ঝুলছিল, সেই হ্যান্ডব্যাগ খুলে কোলের উপর রাখল। সোবাহান সাহেব অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে হ্যান্ডব্যাগের দিকে তাকাতে লাগলেন। তার মন বলছে ছোকরার আসার উদ্দেশ্য এই হ্যান্ডব্যাগেই আছে। কিছু একটা গছাতে এসেছে। সম্ভবত ইনসু্যারেন্স কোম্পানির লোক। পটিয়ে পটিয়ে ইনসু্যারেন্স করিয়ে ফেলবে।
সোবাহান সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, বলুন কি ব্যাপার। সংক্ষেপে বলবেন। লম্বা কথা শোনার সময় বা ধৈৰ্য কোনটাই আমার নেই।
আপনার বাড়ির দোতালার ছাদে দুটা ঘর আছে। ঐ ঘর দুটা কি আপনি ভাড়া দেবেন?
ছাদের ঘর ভাড়া দেয়া হবে এই রকম কোন বিজ্ঞাপন কি আপনার চোখে পড়েছে?
জ্বি না।
তাহলে?
আমি এই এলাকায় বাড়ি খুঁজছিলাম। তখন একজন বলল, এক সময় তেতলার দুটি ঘর আপনি ভাড়া দিতেন।
এক সময় দিতাম বলে সারা জীবন দিতে হবে?
তা-না। আপনি রাগছেন কেন? জোর করে নিশ্চয়ই আমি আপনার বাড়িতে উঠিব না!
আপনি কি করেন?
কিছু করি না।
কিছু করি না মানে? কিছু না করলে সংসার চলে কি ভাবে?
আমি একজন লেখক। লেখালেখি করি।
কি নাম?
আগে একবার বলেছিলাম।
দ্বিতীয়বার বলতে অসুবিধা আছে?
না নেই–আমার নাম আনিস।
এই নামে কোন লেখক আছে বলে তো জানি না।