- বইয়ের নামঃ বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রোম্যান্টিক গল্পের বই
হেদায়েতের (হেদায়েতুল ইসলাম) বয়স তেত্রিশ
বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০০৯
উৎসর্গ
উপন্যাস লেখার একটা পর্যায়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে হতে থাকে। তাদেরকে বই উৎসর্গ করা কি যুক্তিযুক্ত না? ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’ বইটির হেদায়েতের বড় ভাই বেলায়েতকে।
০১.
হেদায়েতের (হেদায়েতুল ইসলাম) বয়স তেত্রিশ। দেখে মনে হয় চল্লিশ। জণ্ডিস রোগীর মতো হলুদ চোখ। মাথার চুল পড়ে গেছে। জুলফির কাছে যা আছে তার বর্ণ তামাটে। সে একটা মেয়েদের কলেজের (বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল কলেজ) অংকের শিক্ষক। ছাত্রীরা তাকে ডাকে গিরগিটি স্যার। তার চেহারার সাথে তারা গিরগিটির মিল খুঁজে পেয়েছে।
হেদায়েত একজন সুখী মানুষ। সুখী মানুষদের ঘুমের কোনো সমস্যা হয় না। হেদায়েতেরও তাই। রাত নয়টার পর থেকে সে হাই তুলতে থাকে। রাত নটায় ঘুমুতে যাওয়া সম্ভব না বলে সে কষ্ট করে জেগে থাকে। টিভিতে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করে। হেদায়েতের স্ত্রী সেতুর টিভি দেখা বাতিক আছে। সে রাত আটটার খবর শেষ হবার পর রিমোট নিয়ে বসে এবং একের পর এক চ্যানেল বদলাতে থাকে। হঠাৎ কোনো একটা চ্যানেল পছন্দ হয়ে গেলে মূতীর মতো হয়ে যায়। চোখে পলক না পড়ার মতো অবস্থা হয়। তার পছন্দ ভূত-প্রেতের ছবি। ভূতের ছবি চলার সময় সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এক হাতে সে হেদায়েতের হাত চেপে ধরে থাকে। সেতুর নখ লম্বা (সৌন্দর্য বিষয়ক কারণে), প্রায়ই হেদায়েতের হাতে নখের দাগ বসে যায়।
এই মুহূর্তে সেতু যে চ্যানেল দেখছে সেখানে কোনো একটা ছবি দেখানো হচ্ছে। ছবিতে একজন বৃদ্ধকে ঘিরে নাচানাচি হচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। দাড়ি সাদা কিন্তু চুল কাশে। হেদায়েত নাচানাচি দেখতে গিয়ে দু’টা জিনিস লক্ষ করল সাতটা মেয়ে নাচছে। সাত হলো একটা প্রাইম নাম্বার। এক এবং সাত ছাড়া এই সংখ্যাকে অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যাবে না। সাতটা মেয়ের সঙ্গে এগারোজন পুরুষও নাচছে। এগারো আরেকটা প্রাইম নাম্বার। বৃদ্ধকে নিয়ে সর্বমোট সংখ্যা উনিশ। উনিশ আরেকটা প্রাইম নাম্বার। নাচের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে প্রাইম নাম্বারেরই খেলা। পরিচালক কি ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই করেছেন, না-কি কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে? ছবিতে নিশ্চয়ই নাচের দৃশ্য আরো কয়েকটি থাকবে। সেখানেও যদি প্রাইম নাম্বারের খেলা দেখা যায়, তা হলে বুঝতে হবে ব্যাপারটা চিন্তা-ভাবনা করে করা। হেদায়েত এখন ছবিটি দেখার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করতে শুরু করল। নড়ে-চড়ে বসল।
সেতু বলল, অসাধারণ ছবি। তাই না?
হেদায়েত মাথা নাড়ল। এই মাথা নাড়া থেকে হা-না বুঝার কোনো উপায় নেই।
সেতু বলল, অমিতাভ আংকেলের অভিনয় দেখেছ? অভিনয় গা থেকে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।
হেদায়েত প্রায় বলেই ফেলছিল, “কোন জন অমিতাভ আংকেল?” শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনতে না পারলে সেতু বিরক্ত হয়। সে মনে করে ইচ্ছা করে না চেনার ভান করা হচ্ছে। ইন্টেলেকচুয়েল সাজার চেষ্টা।
সেতুর বয়স একুশ। সে যথেষ্টই রূপবতী। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় লম্বা (পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি)। গায়ের রঙ গোলাপী না হলেও কাছাকাছি। মাথার চুল কোকড়ানো। তবে কিছুদিন আগে পার্লার থেকে চুল স্ট্রেইট করে এনেছে। এতে তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। রূপবতী মেয়েরা সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করে। সেতুর মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই। তবে আজ সে সুন্দর করে সেজে আছে। গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। সেন্টের নাম ব্লু মুন। কোথাও বেড়াতে যাবার কথা থাকলে সেতু সাজে এবং ব্লু মুন সেন্ট গায়ে মাখে। হেদায়েতের ধারণা মুন খুব বাজে সেন্ট। পিসাবের গন্ধের সঙ্গে লেবু এবং বাসি বেলী ফুলের গন্ধ মিশালে যে গন্ধ হয় সে রকম গন্ধ। হেদায়েত অবশ্যি এই সব কথা সেতুকে বলে নি। সে ঠিক করে রেখেছে কোনো এক দিন খুব ভদ্রভাবে সেতুকে এই কথাটা বলবে। আজই বলা যেতে পারে। আজ সেন্ট থেকে পিসাবের গন্ধটা বেশি আসছে। মনে হচ্ছে ত্রিশ পার্সেন্ট পেসাব, বিশ পার্সেন্ট লেবু এবং পঞ্চাশ পার্সেন্ট বাসি বেলী ফুল। অন্য দিন পিসাবের গন্ধ দশ থেকে পনেরো পার্সেন্টের মধ্যে থাকে।
সেতু বলল, কটা বাজে দেখ তো?
হেদায়েত বলল, নয়টা সতেরো। বলে সে নিজেই চমকালো। নয় একটা প্রাইম সংখ্যা আবার সতেরো একটা প্রাইম সংখ্যা। আজ দেখি প্রাইম সংখ্যার ধুম পড়ে গেছে। ব্যাপার কি?
সেতু বলল, এত সুন্দর ছবি, শেষটা দেখতে পারব না!
হেদায়েত হাই চাপতে চাপতে বলল, শেষটা দেখ। আজ না হয় একটু দেরী করে ঘুমালাম।
সেতু বলল, সাড়ে নটার মধ্যে ব্লবিন ভাই গাড়ি পাঠাবেন। আজ রাতে মার বাসায় থাকব। তুমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছ কেন? তোমাকে তো যেতে বলছি না। মায়ের বাড়িতে তুমি যেতে চাও না, এই খবরটা আমি জানি। আমার মাও জানেন। কোনো অনুষ্ঠানে এই কারণেই মা তোমাকে ডাকেন না।
হেদায়েত অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রয়োজন হলে যাব। অবশ্য আজ শরীরটা খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব।