- বইয়ের নামঃ ভানুসিংহের পদাবলী
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজু, সখি, মুহু মুহু
আজু, সখি, মুহু মুহু গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু দোঁহারে পানে চায়।
যুবনমদবিলসিত পুলকে হিয়া উলসিত,
অবশ তনু অলসিত মুরছি জনু যায়।
আজু মধু চাঁদনী প্রাণ‐উনমাদনী,
শিথিল সব বাঁধনী, শিথিল ভৈ লাজ।
বচন মৃদু মরমর, কাঁপে রিঝ থরথর,
শিহরে তনু জরজর কুসুমবনমাঝ।
মলয় মৃদু কলয়িছে, চরণ নহি চলয়িছে
বচন মুহু খলয়িছে, অঞ্চল লুটায়।
আধফুট শতদল বায়ুভরে টলমল
আঁখি জনু ঢল্ঢল চাহিতে নাহি চায়।
অলকে ফুল কাঁপয়ি কপোলে পড়ে ঝাঁপয়ি,
মধু অনলে তাপয়ি খসয়ি পড়ু পায়।
ঝরই শিরে ফুলদল, যমুনা বহে কলকল,
হাসে শশি ঢলঢল— ভানু মরি যায়
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
কো তুঁহু বোলবি মোয়
কো তুঁহু বোলবি মোয়!
হৃদয়‐মাহ মঝু জাগসি অনুখন, আঁখ‐উপর তুঁহু রচলহি আসন
অরুণ নয়ন তব মরম‐সঙে মম
নিমিখ ন অন্তর হোয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
হৃদয়কমল তব চরণে টলমল, নয়নযুগল মম উছলে ছলছল
প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল
চাহে মিলাইতে তোয়! কো তুঁহু বোলবি মোয়!
বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে
আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে,
উতল প্রাণ উতরোয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল, শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল,
বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল
চরণকমলযুগ ছোঁয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
গোপবধুজন বিকশিতযৌবন, পুলকিত যমুনা মুকুলিত উপবন,
নীল নীর‐’ ধীর সমীরণ,
পলকে প্রাণমন খোয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
তৃষিত আঁখি তব মুখ‐’পর বিহরই, মধুর পরশ তব, রাধা শিহরই,
প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই
পদতলে অপনা থোয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
কো তুঁহু’ ‘কো তুঁহু’ সবজন পুছয়ি, অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি,
যাচে ভানু সব সংশয় ঘুছয়ি—
জনম চরণ‐’পর গোয়। কো তুঁহু বোলবি মোয়!
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে
গহন কুসুমকুঞ্জ‐মাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস লোকলাজে সজনি, আও আও লো॥
পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস, কুঞ্জবনমে আও লো॥
ঢালে কুসুম সুরভভার, ঢালে বিহগসুরবসার,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার বিমল রজতভাতি রে।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে, অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে বকুল যূথি জাতি রে॥
দেখ, লো সখি, শ্যামরায় নয়নে প্রেম উথল যায়—
মধুর বদন অমৃত সদন চন্দ্রমায় নিন্দিছে।
আও আও সজনিবৃন্দ, হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ—
শ্যামকো পদারবিন্দ ভানুসিংহ বন্দিছে॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
বঁধুয়া, হিয়া-পর আও রে
বঁধুয়া, হিয়া‐পর আও রে!
মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মৃদু ভাষয়ি, হমার মুখ‐’পর চাও রে!
যুগ‐যুগ‐সম কত দিবস ভেল গত, শ্যাম, তু আওলি না—
চন্দ‐উজর মধু‐মধুর কুঞ্জ‐’পর মুরলি বজাওলি না!
লয়ি গলি সাথ বয়ানক হাস রে, লয়ি গলি নয়ন‐আনন্দ!
শূন্য কুঞ্জবন, শূন্য হৃদয মন, কঁহি তব ও মুখচন্দ!
ইথি ছিল আকুল গোপনযনজল, কথি ছিল ও তব হাসি!
ইথি ছিল নীরব বংশীবটতট, কথি ছিল ও তব বাঁশি!
তুঝ মুখ চাহয়ি শতযুগভর দুখ ক্ষণে ভেল অবসান।
লেশ হাসি তুঝ দূর করল রে, বিপুল খেদ‐অভিমান।
ধন্য ধন্য রে, ভানু গাহিছে, প্রেমক নাহিক ওর।
হরখে পুলকিত জগত‐চরাচর দুঁহুঁক প্রেমরস‐ভোর॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
বজাও রে মোহন বাঁশি
বজাও রে মোহন বাঁশি।
সার দিবসক বিরহদহনদুখ
মরমক তিয়াষ নাশি॥
রিঝ‐মন‐ভেদন বাঁশরিবাদন
কঁহা শিখলি রে কান!—
হানে থিরথির মরম‐অবশকর
লহু লহু মধুময় বাণ।
ধসধস করতহ উরহ বিয়াকুলু,
ঢুলু ঢুলু অবশ নয়ান।
কত শত বরষক বাত সোঁয়ারয়
অধীর করয় পরান।
কত শত আশা পূরল না বঁধু,
কত সুখ করল পয়ান।
পহু গো, কত শত পীরিতযাতন
হিয়ে বিঁধাওল বাণ।
হৃদয় উদাসয় নয়ন উছাসয়
দারূণ মধুময় গান।
সাধ যায় ইহ যমুনা‐বারিম
ডারব দগধ পরান।
সাধ যায়, বঁধু, রাখি চরণ তব
হৃদয়ামাঝ হৃদয়েশ—
হৃদয়জুড়াওন বদনচন্দ্র তব
হেরব জীবনশেষ।
সাধ যায় ইহ চাঁদমকিরণে
কুসুমিত কুঞ্জবিতানে
বসন্তবায়ে প্রাণ মিশায়ব
বাঁশিক সুমধুর তানে
প্রাণ ভৈবে মঝু বেণুগীতময়,
রাধাময় তব বেণু।
জয় জয় মাধব জয় জয় রাধা,
চরণে প্রণমে ভানু॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
বসন্ত আওল রে
বসন্ত আওল রে!
মধুকর গুন গুন, অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে।
শুন শুন সজনী, হৃদয় প্রাণ মম হরখে আকুল ভেল,
জর জর রিঝসে দুঃখদহন সব দূর দূর চলি গেল।
মরমে বহৈ বসন্তসমীরণ, মরমে ফুটই ফুল,
মরমকুঞ্জ‐’পর বোলই কুহুকুহু অহরহ কোকিলকুল।
সখি রে, উচ্ছল প্রেমভরে অব ঢল ঢল বিহ্বল প্রাণ,
মুগ্ধ নিখিলমন দক্ষীণপবনে গায় রভসরসগান!
বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন কহিছে— দুখিনি রাধা,
কঁহি রে সো প্রিয়, কঁহি সো প্রিয়তম, হৃদিবসন্ত সো মাধা!
ভানু কহে— অতি গহন রয়ন অব, বসন্তসমীরশ্বাসে
মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল ফুল্লবাসনা‐বাসে॥
বাহার
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
বাদরবরখন, নীরদগরজন
বাদরবরখন, নীরদগরজন, বিজুলিচমকন ঘোর,
উপেখই কৈছে আও তু কুঞ্জে নিতিনিতি মাধব মোর।
ঘন ঘন চপলা চমকয় যব পহু, বজরপাত যব হোয়,
তুঁহুক বাত তব সমরযি প্রিয়তম, ডর অতি লাগত মোয়।
অঙ্গবসন তব ভীঁখত মাধব, ঘন ঘন বরখত মেহ,
ক্ষুদ্র বালি হম, হমকো লাগয় কাহ উপেখবি দেহ॥
বইস বইস, পহু, কুসুস্মশয়ন‐’পর পদযুগ দেহ পসারি।
সিক্ত চরণ তব মোছব যতনে কুন্তলভার উঘারি।
শ্রান্ত অঙ্গ তব হে ব্রজসুন্দর, রাখ বক্ষ‐’পর মোর।
তনু তব ঘেরব পুলকিত পরশে বাহুমৃণালক ডোর।
ভানু কহে, বৃকভানুনন্দিনী, প্রেমসিন্ধু মম কালা
তোঁহার লাগয় প্রেমক লাগয় সব কছু সহবে জ্বালা
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
বার বার, সখি, বারণ করনু
বার বার, সখি, বারণ করনু ন যাও মথুরাধাম
বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি করত হমারই শ্যাম।
ধিক্ তুঁহু দাম্ভিক, ধিক্ রসনা ধিক্, লইলি কাহারই নাম।
বোল ত সজনি, মথুরা‐অধিপতি সো কি হমারই শ্যাম।
ধনকো শ্যাম সো, মথুরাপুরকো, রাজ্যমানকো হোয়।
নহ পীরিতিকো, ব্রজকামিনীকো, নিচয় কহনু ময় তোয়।
যব তুঁহু ঠারবি সো নব নরপতি জনি রে করে অবমান—
ছিন্নকুসুমসম ঝরব ধরা‐’পর, পলকে খোয়ব প্রাণ।
বিসরল বিসরল সো সব বিসরল বৃন্দাবনসুখসঙ্গ—
নব নগরে, সখি, নবীন নাগর— উপজল নব নব রঙ্গ।
ভানু কহত, অয়ি বিরহকাতরা, মনমে বাঁধহ থেহ—
মুগুধা বালা, বুঝই বুঝলি না হমার শ্যামক লেহ॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত‐অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু‐অমৃত করে দান॥
আকুল রাধা‐রিঝ অতি জরজর,
ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর—
তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
মরণ, তু আও রে আও।
ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি,
কোর‐উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি
নীদ ভরব সব দেহ।
তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি ছোড়বি,
রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি,
হিয়‐হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন—
অতুলন তোঁহার লেহ।
গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িতচকিত অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু সভয়‐তবধ সব—
পন্থ বিজন অতি ঘোর।
একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে—
ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
পন্থ দেখায়ব মোর।
ভানু ভণে, ‘অয়ি, রাধা, ছিয়ে ছিয়ে
চঞ্চল চিত্ত তোহারি।
জীবনবল্লভ মরণ‐অধিক সো,
অব তুঁহুঁ দেখ বিচারি।’
মাধব না কহ আদরবাণী
মাধব না কহ আদরবাণী, না কর প্রেমক নাম।
জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা ছলনা না কর শ্যাম।
কপট, কাহ তুঁহু ঝূট বোলসি, পীরিত করসি তু মোয়।
ভালে ভালে হম অলপে চিহ্ণনু, না পতিয়াব রে তোয়।
ছিদল‐তরী‐সম কপট প্রেম‐’পর ডরনু যব মনপ্রাণ
ডুবনু ডুবনু রে ঘোর সায়রে, অব কুত নাহিক ত্রাণ।
মাধব, কঠোর বাত হমারা মনে লাগল কি তোর।
মাধব, কাহ তু মলিন করলি মুখ, ক্সমহ গো কুবচন মোর!
নিদয় বাত অব কবহুঁ ন বোলব, তুঁহুঁ মম প্রাণক প্রাণ।
অতিশয় নির্মম, ব্যথিনু হিয়া তব ছোড়য়ি কুবচনবাণ।
মিটল মান অব— ভানু হাসতহিঁ হেরই পীরিতলীলা
কভু অভিমানিনী অদরিণী কভু পীরিতিসাগর বালা॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
শুন লো শুন লো বালিকা
শুন লো শুন লো বালিকা, রাখ কুসুমমালিকা,
কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি, শ্যামচন্দ্র নাহি রে॥
দুলৈ কুসুমমুঞ্জরি, ভমর ফিরই গুঞ্জরি,
অলস যমুন বহয়ি যায় ললিত গীত গাহি রে॥
শশিসনাথ যামিনী, বিরহবিধুর কামিনী,
কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে।
অধর উঠই কাঁপিয়া সখিকরে কর আপিয়া—
কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে॥
মৃদু সমীর সঞ্চলে হরই শিথিল অঞ্চলে
বালিহৃদয় চঞ্চলে কানপথ চাহি রে।
কুঞ্জ‐পানে হেরিয়া অশ্রুবারি ডরিয়া
ভানু গায়— শুন্যকুঞ্জ, শ্যামচন্দ্র নাহি রে॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
শুন, সখি, বাজই বাঁশি
শুন, সখি, বাজই বাঁশি।
শশিকরবিহ্বল নিখিল শূন্যতল এক হরষরসরাশি।
দক্ষিণপবনবিচঞ্চল তরুগণ, চঞ্চল যমুনাবারি।
কুসুমসুবাস উদাস ভৈল সখি উদাস হৃদয় হমারি।
বিগলিত মরম, চরণ খলিতগতি, শরম ভরম গয়ি দূর।
নয়ন বারিভর, গরগর অন্তর, হৃদয় পুলকপরিপূর।
কহ সখি, কহ সখি, মিনতি রাখ সখি, সো কি হমারি শ্যাম॥
গগনে গগনে ধ্বনিছে বাঁশরি সো কি হমারি নাম।
কত কত যুগ, সখি, পুণ্য করিনু হম, দেবত করনু ধেয়ান—
তব্ ত মিলল, সখি, শ্যামরতন মম— শ্যাম পরানক প্রাণ।
শুনত শুনত তব্ মোহন বাঁশি জপত জপত তব নামে
সাধ ভইল ময়্ প্রাণ মিলায়ব চাঁদ‐উজল যমিনামে!
চলহ তুরিতগতি, শ্যাম চকিত অতি— ধরহ সখীজন‐হাত।
নীদমগন মহী, ভয় ডর কছু নহি, ভানু চলে তব সাথ॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর
শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর!
বিরহ সাথি করি দুঃখিনি রাধা রজনী করত হি ভোর।
একলি নিরল বিরল‐’পর বৈঠত, নিরখত যমুনা‐পানে—
বরখ্ত অশ্রু, বচন নহি নিকসত, পরান থেহ ন মানে।
গহনতিমির নিশি, ঝিল্লিমুখর দিশি’ শূন্য কদমতরুমূলে
ভূমিশয়ন‐’পর আকুলকুন্তল রোদৈ আপন ভূলে।
মুগুধ মৃগীসম চমকি উঠই কভু পরিহরি সব গৃহকাজে,
চাহি শূন্য‐’পরে কহে করুণস্বর— বাজে বাঁশরি বাজে।
নিঠুর শ্যাম রে, কৈসন অব তুঁহুঁ রহই দূর মথুরায়—
রয়ন নিদারুণ কৈসন যাপসি, কৈস দিবস তব যায়!
কৈস মিটাওসি প্রেমপিপাসা, কঁহা বজাওসি বাঁশি!
পীতবাস তুঁহুঁ কথি রে ছোড়লি, কথি সো বঙ্কিম হাসি!
কনকহার অব পহিরলি কণ্ঠে, কথি ফেকলি বনমালা!
হৃদিকমলাসন শূন্য করলি রে, কনকাসন কর আলা!
এ দুখ চিরদিন রহল চিত্তমে, ভানু কহে— ছি ছি কালা!
ঝটতি আও তুঁহুঁ হমারি সাথে, বিরহব্যাকুলা বালা।
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে
শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে হাস বিকাশত কায়,
কোন স্বপন অব দেখত মাধব, কহবে কোন হমায়!
নীদ‐মেঘ‐’পর স্বপন‐বিজলি‐সম রাধা বিলসত হাসি।
শ্যাম, শ্যাম মম, কৈসে শোধব তূঁহুক প্রেমঋণরাশি
বিহঙ্গ, কাহ তু বোলন লাগলি, শ্যাম ঘুমায় হমারা।
রহ রহ চন্দ্রম, ঢাল ঢাল তব শীতল জোছনধারা
তারকমালিনী সুন্দরযামিনী অবহুঁ ন যাও রে ভাগি—
নিরদয় রবি অন কাহ তু আওলি জ্বাললি বিরহক আগি।
ভানু কহত অব, রবি অতি নিষ্ঠুর, নলিনমিলন‐অভিলাষে
কত নরনারিক মিলন টুটাওত, ডরত বিরহহুতাশে॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সখি রে, পিরীত বুঝবে কে
সখি রে, পিরীত বুঝবে কে!
আঁধার হৃদয়ক দুঃখকাহিনী বোলব, শুনবে কে।
রাধিকার অতি অন্তরবেদন কে বুঝবে অযি সজনি।
কে বুঝবে, সখি, রোয়ত রাধা কোন দুখে দিনরজনী।
কলঙ্ক রাটায়ব জনি, সখি, রটাও— কলঙ্ক নাহিক মানি,
সকল তয়গব লভিতে শ্যামক একঠো আদরবাণী।
মিনতি করি লো সখি, শত শত বার, তু শ্যামকো না দিহ গারি—
শীল মান কুল অপনি, সজনি, হম চরণে দেযনু ডারি।
সখি লো, বৃন্দাবনকো দুরুজন মানুখ পিরীত নাহিক জানে,
বৃথাই নিন্দা কাহ রটায়ত হমার শ্যামক নামে।
কলঙ্কিনি হম রাধা, সখি লো, ঘৃণা করহ জনি মনমে।
ন আসিও তব্ কবহুঁ, সজনি লো, হমার অঁধা ভবনমে।
কহে ভানু অব, বুঝবে না, সখি কোহি মরমকো বাত—
বিরলে শ্যামক কহিও বেদন বক্ষে রাখৈ মাথ॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায়
করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা,
কঠিন‐হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়।
মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা, বয়ন‐পান তছু চাহল রাধা,
চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল— দণ্ড দণ্ড, সখি, চাহয়ি রহল—
মন্দ মন্দ, সখি— নয়নে বহল বিন্দু বিন্দু জলধার।
মৃদু মৃদু হাসে বৈঠল পাশে, কহল শ্যাম কত মৃদু মধু ভাষে।
টুটয়ি গইল পণ, টুটইল মান, গদগদ আকুল ব্যাকুল প্রাণ,
ফুকরয়ি উছসয়ি কাঁদিল রাধা— গদগদ ভাষ নিকাশল আধা—
শ্যামক চরণে বাহু পসারি কহল, শ্যাম রে, শ্যাম হমারি,
রহ তুঁহু, রহ তুঁহু, বঁধু গো রহ তুঁহু, অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু—
তুঁহু বিনে মাধব, বল্লভ, বান্ধব, আছয় কোন হমার!
পড়ল ভূমি‐’পর শ্যামচরণ ধরি, রাখল মুখ তছু শ্যামচরণ‐’পরি,
উছসি উছসি কত কাঁদয়ি কাঁদয়ি রজনি করল প্রভাত।
মাধব বৈসল, মৃদু মধু হাসল
কত অশোয়াস‐বচন মিঠ ভাষল, ধরইল বালিক হাত।
সখি লো, সখি লো, বোল ত সখি লো, যত দুখ পাওল রাধা,
নিঠুর শ্যাম কিয়ে আপন মনমে পাওল তছু কছু আধা।
হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি বহুত স প্রবোধ দেল,
হাসয়ি হাসয়ি পলটয়ি চাহয়ি দূর দূর চলি গেল।
অব সো মথুরাপুরক পন্থমে ইঁহ যব রোয়ত রাধা।
মরমে কি লাগল তিলভর বেদন, চরণে কি তিলভর বাধা।
বরখি আঁখিজল ভানু কহে, অতি দুখের জীবন ভাই।
হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু কাঁদিবার কো নাই।।
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সজনি সজনি রাধিকা লো
সজনি সজনি রাধিকা লো, দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া॥
পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া।
সুন্দর সিন্দুর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া॥
সহচরি সব নাচ নাচ মিলনগীত গাও রে,
চঞ্চল মঞ্জরীরাব কুঞ্জগগনে ছাও রে।
সজনি, অব উজার’ মঁদির কনকদীপ জ্বালিয়া,
সুরভি করহ কুঞ্জভবন গন্ধসলিল ঢালিয়া॥
মল্লিকা চমেলি বেলি কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ যূথি, গাঁথ জাতি, গাঁথ বকুলমালিক;
তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ কুঞ্জপথ চাহিয়া—
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
সতিমির রজনি, সচকিত সজনী
সতিমির রজনি, সচকিত সজনী, শূন্য নিকুঞ্জ‐অরণ্য।
কলয়িত মলয়ে, সুবিজন নিলয়ে বালা বিরহবিষণ্ণ॥
নীল আকাশে তারক ভাসে, যমুনা গাওত গান।
পাদপ‐মরমর, নির্ঝর‐ঝরঝর, কুসুমিত বল্লিবিতান।
তৃষিত নয়ানে বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা—
দেখ ন পাওয়ে, আঁখ ফিরাওয়ে, গাঁথে বনফুলমালা!
সহসা রাধা চাহল সচকিত, দূরে খেপল মালা—
কহল, সজনি, শুন বাঁশরি বাজে, কুঞ্জে আওল কালা।
চমকি গহন নিশি দূর দূর দিশি বাজত বাঁশি সুতানে—
কণ্ঠ মিলাওল ঢলঢল যমুনা কলকল কল্লোলগানে।
ভনে ভানু— অব শুন গো কানু, পিয়াসিত গোপিনিপ্রাণ
তোঁহার পীরিত বিমল অমৃতরস হরষে করবে পান॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
হম যব না রব, সজনী
হম যব না রব, সজনী,
নিভৃত বসন্তনিকুঞ্জবিতানে আসবে নির্মল রজনী—
মিলনপিপাসিত আসবে যব, সখি, শ্যাম হমারি আশে,
ফুকারবে যব ‘রাধা রাধা’ মুরলি ঊরধ শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছুটই যব হম আওব না,
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই যব হম জাগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে হেরবে আকুল শ্যাম।
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে ‘রাধা রাধা’ নাম।
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম, শ্যামক শত শত নারী—
হম যব যাওব শত শত রাধা চরণে রহবে তারি।
তব্ সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে, কাহে তয়াগব দে।
হমারি লাগি এ বৃন্দাবনমে কহ, সখি, রোয়ব কে।
ভানু কহে চুপি, মানভরে রহে, আও বনে ব্রজনারী—
মিলবে শ্যামক থরথর আদর, ঝরঝর লোচনবারি॥
১২৮৮ শ্রাবণ– আনুমানিক ১২৯২
হম, সখি, দারিদ নারী
হম, সখি, দারিদ নারী।
জনম অবধি হম পীরিতি করনু, মোচনু লোচনবারি।
রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ, দুখিনী আহির জাতি—
নাহি জানি কছু বিলাস‐ভঙ্গিম যৌবনগরবে মাতি—
অবলা রমণী, ক্ষুদ্র হৃদয় ভরি পীরিত করনে জানি।
এক নিমিখ পল নিরখি শ্যাম জনি, সোই বহুত করি মানি।
কুঞ্জপথে যব নিরখি সজনি হম শ্যামক চরণক চীনা
শত শত বেরি ধূলি চুম্বি সখি, রতন পাই জনু দীনা
নিঠুর বিধাতা, এ দুখজনমে, মাঙব কি তুয়া‐পাশ।
জনম‐অভাগী উপেখিতা হম বহুত নাহি করি আশ—
দূর থাকি হম রূপ হেরইব, দূরে শুনইব বাঁশি,
দূর দূর রহি সুখে নিরখিব শ্যামক মোহন হাসি।
শ্যামপ্রেয়সি রাধা! সখি লো! থাক’ সুখে চিরদিন—
তুয় সুখে হম রোয়ব না সখি, অভাগিনী গুণহীন।
আপন দুখে, সখি, হম রোয়ব লো, নিভৃতে মুছৈব বারি।
কোহি ন জানব, কোন বিষাদে, তন‐মন দহে হমারি।
ভানুসিংহ ভনয়ে, শুন কালা,
দুখিনি অবলা বালা—
উপেখার অতি ভিখিনি বাণে না দিহ না দিহ জ্বালা
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে, কণ্ঠে শুখাওল মালা।
বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী, নহি নহি আওল কালা॥
বুঝনু বুঝনু, সখি, বিফল বিফল সব, বিফল এ পীরিতি লেহা।
বিফল রে অ মঝু জীবন যৌবন, বিফল রে এ মঝু দেহা॥
চল সখি, গৃহ চল, মুঞ্চ নয়নজল— চল সখি চল গৃহকাজে।
মলতিমাল রাখহ বালা— ছি ছি সখি, মরু মরু লাজে।
সখি লো, দারুণ আধিভরাতুর এ তরুন যৌবন মোর।
সখি লো, দারুণ প্রণয়হলাহল জীবন করল অঘোর॥
তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী শ্যামক দরশন আশে।
আকুল জীবন থেহ ন মানে, অহরহ জ্বলত হুতাশে।
সজনি, সত্য কহি তোয়,
খোয়ব কব হম শ্যামক প্রেম সদা ডর লাগে মোয়॥
হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব, সো দিন আসব সখি রে—
বাত ন বোলবে, বদন ন হেরবে! মরিব হলাহল ভখি রে।
ঐস বৃথা ভয় না কর বালা ভানু নিবেদয় চরণে—
সুজনক পীরিতি নৌতন নিতি নিতি, নাহি টুটে জীবনমরণে॥
১২৮৮ শ্রাবণ— আনুমানিক ১২৯২
০১. উৎসর্গ ও সূচনা (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী)
উৎসর্গ
ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার
অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই।
আজ ছাপাইছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।
সূচনা
অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে যাঁরা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তাঁরা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোম্বাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়াছি তখন আমার বয়স সতেরো। নূতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওযা যাক, তখন আমি চোদ্দয় পা দিয়েছি। খন্ড খন্ড পদাবলীর প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক্ থেকে যখন সেগুলি অন্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত। তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পরে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সাথে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি। প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তপুরের কোণের ঘরে––
গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না। এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।
শান্তিনিকেতন
১১|৭|৪০