কাদের এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়াল এবং গভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় মামার মত বুদ্ধির লোক এই দুনিয়ায় আল্লাহতালা বেশি পয়দা করে নাই। এইটা কাগজে-পত্রে ছাপা দরকার। আফা আপনে আমার মতামত লেখেন।
বিলু সোবাহান সাহেবের মতামতের পাশে কাদেরের মতামতও লিখল। তবে সভায় শুধু মাত্র সত্য দিবসের উপরই সিদ্ধান্ত নেয়া হল। ঠিক হল এই বাড়িতে মঙ্গলবার হবে সত্য দিবস। এই সত্য দিবসে কেউ কোন মিথ্যা বলবে না। কাদের প্রশ্ন তুলল, জীবন রক্ষার জন্যে যদি মিথ্যা বলার দরকার হয় তখন কি করা? এর উত্তরে সোবাহান সাহেব বলল, চুপ কর গাধা।
কাদের অন্ধকার মুখ করে বলল, বিষয়টার নিন্দা হওয়া দরকার।
গভীর বিস্ময়ে পুরা ব্যাপারটা পুতুল লক্ষ্য করছে। এ রকম একটা ব্যবস্থা যে কোন বাড়িতে চালু থাকতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। জীবনকে আনন্দময় করে তোলার এই সব উপকরণ তাকে মুগ্ধ ও অভিভূত করল। শুধু এমদাদ খোন্দকার সারাক্ষণ মুখ বিকৃত করে রইলেন এবং রাতে ঘুমুতে যাবার সময় পুতুলকে বললেন, আইজ একটা জিনিস শিখলাম পুতুল।
পুতুল বলল, কি জিনিস?
আইজ শিখলাম যে দলের গোদা যদি বেকুব হয় তা হইলে সব কয়টা বেকুব হয়। এই বাড়ির সব কয়টা মানুষ চাপে বোকা এইটা লক্ষ্য করছস?
পুতুল মুগ্ধ স্বরে বলল, এসব কাণ্ড কারখানা আমার বড় ভাল লাগছে। এদের নিয়ে কোন মন্দ কথা তুমি বলব না দাদাজান।
বেকুবরে বেকুব বলব না?
এরা বেকুব না। দাদাজান। এরা…
পুতুল কথা শেষ করল না। তার অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু দাদাজানকে এসব বলার অর্থ হয় না। দাদাজান বুঝবে না। সবাই সব জিনিস বুঝে না।
পুতুলের ইচ্ছা করছে তার নিজের যখন একটা সংসার হবে সেই সংসারেও এ রকম পারিবারিক সভা বসবে। সেই সভার সব বিবরণও এরকম করে লেখা হবে। আলোচনা হবে। জীবনের একঘেয়েমি এইভাবেই দূর করা হবে। একটাইতো আমাদের জীবন। লক্ষ কোটি জীবনতো আমাদের না। কেন আমরা এই জীবনকে সুন্দর করব না।
সত্য দিবস খুব কঠিনভাবে পালিত হতে থাকল।
মঙ্গলবার ভোরে ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা হয় আজ সত্য দিবস। কাদের সেই ব্ল্যাক বোর্ডে বসার ঘরে ঝুলিয়ে দিয়ে আসে। সত্য দিবস শুরু হয়। কাদের এবং রহিমার মা দুজনই। এই দিবস কঠিন ভাবে মেনে চলে। যে ইলিশ মাছ অন্যদিন পঞ্চাশ টাকায় আনা হয়। সেই মাছ মঙ্গলবার কেনা হয় চল্লিশ টাকায়।
মিতু বিস্মিত হয়ে বলেন, আজ মাছ সস্তা নাকি?
কাদের উদার হয়ে বলে— না।
মিনু বলেন, তাহলে তুই চল্লিশ টাকায় এই মাছ আনলি কি করে?
কাদের চুপ করে থাকে। কথা বলতে গেলেই সমস্যা। থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে। সারাটা দিন তার বড়ই অস্বস্তিতে কাটে। রাত বারটায় হাফ ছেড়ে বাঁচে।
পুতুলও সত্য দিবসের ব্যাপারটা খুব মনে রাখতে চেষ্টা করে। এমনিতেই তার মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবু মঙ্গলবারে সে আরো সাবধান থাকে। যেন ভুলেও কোন মিথ্যা বের না হয়। পুতুল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করল এই মঙ্গলবারেই বেছে বেছে তার দাদাজান বড় বড় মিথ্যা কথাগুলো বলেন। কেন তিনি এমন করেন কে জানে। মিথ্যা কথাগুলো অন্যদিন বললে কি হয়? এই নিয়ে আনিসের সঙ্গে তার কথা হল। আনিস হেসে বলল, সত্য দিবসের ব্যাপারটা তুমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছ বলে মনে হয়। এটা এমন কঠিন ভাবে গ্রহণ করার কিছু নেই।
পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, নেই কেন?
আনিস হাসতে হাসতে বলল, পুরো ব্যাপারটাই ভুল।
ভুল?
হ্যাঁ ভুল। সপ্তাহের একটা বিশেষ দিন সত্য দিবস এর মানে হচ্ছে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে মিথ্যা বলা যাবে। সত্য বলতে হবে সত্য দিবসে। ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে না?
পুতুল কিছু বলল না। সে খানিকটা ধাধায় পড়ে গেছে। এমন ভাবে সে ভাবেনি আনিস বলল, দেখ পুতুল–দিবসের ব্যাপারটাই আমার ভাল লাগে না— একটা বিশেষ দিনকে করা হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। সব দিনইতো শিশু দিবস হওয়া উচিত। উচিত না?
হ্যাঁ তাতো ঠিকই।
অবশ্যি এইসব দিবসের একটা উপকারিতাও আছে।
কি উপকারিতা?
মনে করিয়ে দেবার একটা ব্যাপার আছে। বছরের একটি বিশেষ দিনকে সত্য দিবস করা মানে ঐ দিনে সত্য কথার প্রয়ােজনীয়তার দিকটির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি দুদিকেই যুক্তি দিতে পারেন।
আনিস হাসতে হাসতে বলল, তা পারি। এই পৃথিবীতে সব কিছুর অভাব আছে কিন্তু যুক্তির অভাব নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যেমন কঠিন যুক্তি আছে বিপক্ষেও তেমনি কঠিন যুক্তি আছে।
আপনি আল্লাহ বিশ্বাস করেন না কেন?
তুমি কর?
কি আশ্চৰ্য আমি করব না? আপনি সত্যি করেন না?
না। রাত্রির সঙ্গে এই নিয়ে প্রায়ই আমাদের ঝগড়া হত। সে তর্কে হেরে যেত। তর্কে হেরে গেলেই তার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হত। একবার তর্কে হেরে সে কি করল জান? আমার খুব দামী একটা পাঞ্জাবী ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলল।
আনিস অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। রাত্রির কথা সে কখনো মনে করতে চায় না। কিন্তু এই মেয়েটির নানান ভঙ্গিতে রাত্রির কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি কি পুতুল ইচ্ছা করেই করে?
আনিস খানিকটা অস্বস্তিও বোধ করে। পুতুলের চোখে সে এক ধরনের মুগ্ধতা দেখতে পায়। এই মুগ্ধতা সব সময় থাকে না। হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠে। পরীক্ষণেই মেয়েটির মুখ বিষণ্ণ হয়ে যায়। আনিস রাত্রির চোখেও এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিল। এই মুগ্ধতা দেখার একটা আলাদা নেশা আছে। একবার দেখতে পেলে বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। আনিস লক্ষ্য করছে সে ইদানিং নিজের অজান্তেই এই মেয়েটিকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। সে জানে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। সাবধান হতে হবে। আরো সাবধান হতে হবে।