মৌলবী সাহেব টানা সুরে থেমে থেমে কি বলে যান তার একটা কথাও তার কানে ঢোকে না। কেরামত যখন আবার তার হাত থেকে পাগড়ির প্রান্তটা নিতে আসে, তখন তার সম্বিত ফিরে আসে।
এবার খাওয়ার পালা।
জয়গুন তওবা করায় আজ মৌলবী সাহেবেরও খেতে আপত্তি নেই। একদিন তিনি জয়গুনের দেয়া হাঁসের ডিম ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেইদিনের সেই জয়গুন আর এখনকার জয়গুনে তফাত অনেক। একটু আগেও সে মৌলবী সাহেবের কাছে ছিল রাস্তার কুকুরের সামিল।
গদু প্রধান সামনের সারির একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে—কিরে আদেল, ভাত সামনে কইর্যা বইস্যা আছস ক্যান? খাইতে পারস না বুঝি?
—পারমু না ক্যাঁ? দুধ দিয়া মাইর্যা দিমু।
সাদত আলী বলে—আইজ কাইলকার ছেঁড়ারা পোয়া চাউলের ভাত খাইতে পারে না। এই বয়সে আমরা লোয়া খাইয়া লোয়া অজম করছি। খাইতে খাইতে মাজার কাপড় যে। কয়বার ঢিলা করতে অইত তার শুমার নাই।
গদু প্রধান বলে—জোয়ান বয়সের কালে এক সের চাউলের ভাত অজম করছি আমি।
সাদত আলী বলে—পরধানের মনে আছে? হেই মধু আলইকরের দোকানে তুমি আর আমি বাজী রাইখ্যা রসোগোল্লা খাইছিলাম। তুমি আমার তন ছয়খান বেশী খাইছিল। আমি খাইছিলাম একচল্লিশটা, আর তুমি–
—আর আমি সাতচল্লিশটা। সাদত আলীর কথা শেষ না হতেই গদু প্রধান বলে।
লেদু পাশ থেকে বলে রাইখ্যা দ্যাও ওই হগল কিচ্ছা। আইজ কাইলকার ডোরা খাইতে পারে না? খাইতে পারে, মিয়াভাই কিন্তু খাওয়ায় কেডা? খাইতে না পারলে ভালই আছিল। খোদা খোরাক কমাইয়া দিলে ত খুশী অইতাম। শুকুর ভেজতাম খোদার দরবারে। মসজিদে শিন্নি দিতাম!
লেদুর মাথায় ছিট আছে। কিন্তু তার স্পষ্টবাদিতার জন্য অনেকে তাকে পছন্দ করে। গদু প্রধান কিছু বুঝতে না পেরে বলে—কি রহম?
—বোঝলা না, মিয়াভাই? তোমার গোলাভরা ধান আছে। এক সেরের বদলে দুই সের খাইলেও তোমার গোলা ঠিক থাকব। কিন্তু আমি সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলাইয়া রুজি করি পাঁচ সিকা। এই টাকা পেড়ে দিমু, কাপোড় পিল্ম, না এর তন রাজার খাজনা দিমু? ঘরে পরিবার আছে। তিনডা বাচ্চা আছে। আমার পেড যদি তোমার মতন এক সের খাইতে চায়, তয় উপায়খান অইব কি? সারাদিন খাইট্যা সোয়া সের চাউল গামছায় বাইন্দা ঘরে ফিরি। সাধে কি আর আইজকাইলকার ছেঁড়ারা খাইতে পারে না। খাইতে পারে না, না, খাইতে পায় না, কও। মাইনষের পেড ছোড অইয়া যাউক খোদার কাছে আরজ করি। বেবাকের পেড়ে মাজায় লাইগ্যা এক অউক। এক ছড়াকের বেশী যেন খাইতে না অয়। এইডা অইলে আর আকাল অইব না দ্যাশে।
অনেকক্ষণ ধরে থাকা গ্রাসটা এবার মুখে দেয় লেদু।
তার কথা সবারই ভালো লাগে। শুধু দাদু প্রধানের কাছে ভালো লাগে না। সে এবার। হক দেয়–আরে, এই খানে ভাতের গামলা লও। ডাইল লও। কেমুন খাদেম, অ্যাঁ! খানেওয়ালা চিন না?
থালার ওপর ঝুঁকে পড়া নিব্জদেহ বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিন মাথা উঠিয়ে বলে—লেদুরে আমরা। পাগল কই আর ছাগল কই, ওর কথা কাডায় কাডায় সত্য। মাইনষের পেডটা না থাকলে আমি খুশী অইতাম। পেডের জ্বালাই বড় জ্বালা মাইনষের। নানা জনের নানা কথার মধ্য দিয়ে খাওয়া শেষ হয়। সোলেমান খাঁ মজলিশের মধ্যে একটা জায়গায় নিজের কাঁধের গামছাটা বিছিয়ে দেয়। তার চারপাশে কন্যাপক্ষের কেরামত ও জহিরুদ্দিন এবং বরপক্ষের প্রায় সমস্ত লোক কাঁধে কাঁধে মেশামেশি হয়ে বসে। প্রথম সারির পেছনে অল্প বয়সী ছেলেরা হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে তাকায় উৎসুক হয়ে।
সোলেমান খাঁ একটা টিনের পুরাতন সুটকেস খুলে গয়নাগুলো গামছার ওপর আলাদা করে জোড়ায় জোড়ায় সাজিয়ে রাখে। গয়নার মধ্যে বয়লা, গোলখাড়, নাকফুল, নোলক। এগুলো হাত দিয়ে নেড়ে প্রথমেই আপত্তি করে কেরামত—আপনের গয়নার জোখা নেন নাই? এত বড় গয়না কে পরব?
—বড় অওয়ন ভালা। বউ আমাগ অহন ডেগা অইলে কি অইব? এক বচ্ছর পর যহন। সিয়ানা অইব তহন ঠিক কাপাকাপা অইব। ভাঙা-গড়া করলে রূপা আর রূপা থাকে না। ফুক্কা আইয়া যায়।
আসলে গয়নাগুলো ছিল ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর। সে মারা যাওয়ার পর চোখা রূপার এই গয়নাগুলোকে মেজে ধুয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
জহিরুদ্দিন গয়না হাতে নিয়ে ভালো করে পরখ করে। নাকের নোলক ও নাকফুল ছাড়া আর কোনটাই তার কাছে রূপার বলে মনে হয় না। সে কেমিক্যালের কানফুল জোড়া এক দিকে সরিয়ে হাত দিয়ে আর গুলো চোখের কাছে নিয়ে দেখে। কিন্তু বরপক্ষের এত লোকের সামনে কথা বলতে তার সাহস হয় না। সত্যিই যদি রাপার জিনিস হয়ে থাকে তবে মজলিশের এত লোকের সামনে লজ্জায় কান কাটা যাবে। কেউ হয়ত বলেও বসতে পারে—বাপের বয়সে রূপা দ্যাহ নাই কোন দিন?
ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর পাটের শাড়ী, একখানা লাল পেড়ে শাড়ী ও গয়নাগুলো ঘরে নিয়ে যায় কেরামত। হাতের বয়লা ও পায়ের গোলখাড় সুতো দিয়ে বেঁধে পরিয়ে দেওয়া হয় মায়মুনকে। পাটের দশ হাত শাড়ীটা এমন পেঁচিয়ে সামলান হয় যে, দূর থেকে মায়মুনকে দেখে বোঝা যায় না। মনে হয় একটা কাপড়ের পুটলি।
মায়মুন আবদারের সাথে তার মা-কে বলে—মা, তুমি যাইবা না আমার লগে?
—আমি যাইমু কি করতে মা?
—আমি তোমারে ছাইড়্যা কেমনে থাকতাম?
—ক্যাঁ? হাসু যাইব, শফি যাইব।
মায়মুন নিশ্চিন্ত হয়।
জয়গুণ আবার বলে—তোর চিন্তা নাই। দুই দিনের বেশী রাখতাম না তোরে পরের বাড়ী। পরশু লইয়া আইমু আবার। এই বার আঁইট্যা যা দেহি দুয়ার তক, দেহি কেমুন দাহা যায়।