জয়গুনের প্রথম স্বামী জব্বর মুন্সী এই মৌলবী সাহেবের খুবই প্রিয়পাত্র ছিল। তার স্ত্রী সদর রাস্তায় হাঁটে তা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। কতবার লোক পাঠিয়ে তিনি জয়গুনকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জয়ন তা শোনেনি।
ডিম ও গন্ধ ভাদাল পাতা বেচতে বেশী সময় লাগে না। উকিলপাড়ায়ই আজ সমস্ত কাবার হয়ে যায়। ঝাকা নামান মাত্র চিলিবিলি করে নিয়ে যায় সব।
জয়গুন বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় লবণ, মরিচ, গরীবের বিলাসদ্রব্য পান-সুপারি এবং আরো কয়েকটা প্রয়োজনীয় সওদা কেনে। রাস্তার এক জায়গায় আখ বিক্রি হচ্ছে। গাছের সাথে বাঁশ বেঁধে উচ্চতা ও দামের ক্রমানুসারে সারি সারি আখ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মায়মুন কতদিন মাকে বোম্বাই আখ নিতে বলেছে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই এতদিন নেয় নি, অযথা পয়সা খরচ হবে বলে। মায়মুনকে ফাঁকি দিয়ে সে বলেছে—উখের কি খায়? অহনো মিড়া অয় নাই। পানসে উখ খাওয়ন আর ঘাস খাওয়ন সমান কথা।
কিন্তু আজ সারি সারি আখ দেখে তার মনে ব্যথা লাগে। সে ভাবে-মওসুমের একটা জিনিস কার না মুখে দিতে ইচ্ছে হয়? আর মায়মুন ত নেহায়েত কচি মেয়ে।
জয়গুন তিন আনা দিয়ে একটা আখ কেনে।
রাস্তায় রাজার মা-র সাথে দেখা হয়। রাজার মা জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী। সে জিজ্ঞেস করে—কত দিয়া কিনলাগে! উখখান?
—বা-রো পয়সা।
রাজার মা মাথায় হাত দেয়। সে আবার বলে—তিন আঙুল উখ না, দাম তিন আনা! উহতু না—অষুধ। আস্তা পয়সা চাবাইয়া খাওয়ান।
-এই রহমই বইন। আমাগ ঘরের জিনিসের দর নাই। আমরা যা বেচতে যাই-হস্তা। এক্কেরে পানির দাম। বাজারে একটা আদনা চিজ কিনতে গিয়া দ্যাহ, গহটের পয়সায় কুল পাইবা না। একটু থেমে আবার বলে—এই চাঙারির এক চাঙারি শাক, এক্কেরে তরতাজা বেচলাম চাইব আনা। আর দ্যাহ, আষ্ট আনার বেহাতি কোন নিচে পইড়্যা আছে।
—দেখছি বইন। এই দশা। এহন যাই গো। দেহি চাউলেরনি যোগাড় করতে পারি। আইজ গাড়ীতে ওঠতে পারলাম না। যা ভিড়। মাগগো মা!
—পুরুষ মাইনষেই ওঠতে পারে না গাড়ীতে। আমরা ত মাইয়া মানুষ। কাইল পরশু আবার যাইবা নি গো? গেলে লইয়া যাইও আমারে। দ্যাশের চাউলে প্যাট ভরে না। চাউলের দাম যেন রোজ রোজ ওঠতেই আছে।
রাজার মা এতক্ষণে কয়েক পা এগিয়ে গেছে। জয়গুন হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, আর বুঝি উত্তরে যাওয়া হয় না। লোকের ভিড়ে গাড়ীতে ওঠবার যো নেই। কত লোক হাতল ধরে পা-দানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ীর ছাতে বসে যায় কত লোক। সেদিন তার চোখের সামনে একটা লোক গাড়ীর পা-দানের ওপর থেকে পড়ে গেল।
টিকেটর জন্যেও আবার খুব কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিনা টিকেটে লুকিয়ে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে আর কত দিন যাওয়া যায়? জয়গুনদের গ্রামের জহিরুদ্দিন বিনা টিকেটে গাড়ী চড়ায় তিনদিন ফাটক খেঠে এসেছে।
পথে আসতে একটা উদলা নৌকার ওপর জয়গুনের দৃষ্টি পড়ে। রেল-রাস্তার পাশে গাছের সাথে বাধা ছোট নৌকাটি। একটি ছোট ছেলে বসে আছে নৌকার ওপর। যে কোন ছোট ছেলে হাতের কাছে পেলেই সে কোলে তুলে নেয়। তার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। কাসুর নাক, কাসুর চোখ, তার কপাল, যুগল গায়ের রঙ কেমন ছিল আজও জয়গুনের চোখের সামনে ভাসে। কারও ছোট ছেলে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে মন্তব্য করে—ওর নাকটা আমার কাসুর নাকের মতন। আমার কাসুরও এই রহম জোড়-ভুরু। জোড়-ভুরু ভাইগ্যমানের লক্ষণ। কিন্তু অইলে কি অইব? যে দশ মাস দশ দিন উদরে রাখল, তার বুক খালি।
একটা নিশ্বাস ছেড়ে সে আবার বলে—থাক আমি শাপ দিমু না কাউরে। আমার কাসু। “জান-ছালামতে বাঁইচ্যা থাউক-খোদার কাছে দিন-রাইত চবিবশ ঘটা এইডাই আরজ করি।
নৌকায় বসা ছেলেটার দিকে চেয়ে দ্রুয়গনের মনে হয়, তার কাসুও এতদিনে হয়তো এতটা বড় হয়েছে।
নৌকাটার দিকে আর একবার চেয়ে দেখে জয়গুন। এ রকম একটা নৌকা করিম বকশেরও ছিল। নৌকার মাঝে একটা কোঁচও দেখা যায় ঠিক করিম বকশের কোঁচটার মতই। সে ভালো করে দেখে। তাইত! করিম বকশের কোঁচটাই। কোন ভুল নেই।
জয়গুন থমকে দাঁড়ায়। তার মনে আনন্দ ও আবেগের মিলনসংঘাত আবর্তের সৃষ্টি করে। সে ভুলে যায়, আসমানে না জমিনে, স্বপ্নে না জাগরণে কোথায় কোন অবস্থায় সে আছে।
মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কাখের ঝাকাটা রাস্তার ওপর ফেলে সে নৌকার দিকে ছুটে যায়।
নৌকায় পা দিতেই ছেলেটি বলে—উইট্য না আমাগ নায়।
জয়গুন উত্তর না দিয়ে নৌকায় ওঠে। ছে
লেটি বলে—ক্যাদা মাইখ্যা দিল যে! বাজান আমারে মারব।
জয়গুনের খেয়াল নেই। সে কাদা পায়েই উঠে পড়েছে।
জয়গুন ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে। তার চিবুক ধরে বলে—তোমার নাম কি?
ছেলেটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তার দিকে। মুখ না নামিয়ে আস্তে বলে—কাসু।
–কাসু! কাসু! আমার কাস! জয়গুন পাগল হয়ে গেল বুঝি। সে দুই হাতে কাসুকে জড়িয়ে ধরতে যায়। কাসু সে হাত সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
জয়গুন ভাবে—আজ সে পেটের সন্তানের কাছে পর হয়ে গেছে।
জয়গুন কাসুকে কোলে নেয়। কিন্তু কাসু কোস্তাকুস্তি করে কোল থেকে নেমে যায়।
জয়গুন আখ খেতে দেয় কাসুকে। নিজের দাঁত দিয়ে চোকলা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে তার মুখে দেয়। কাসু চিবোয়। জয়গুন অশেষ তৃপ্তির সাথে তার দিকে চেয়ে দেখে।
এক সময়ে জয়গুন বলে—তোমার বাজান কই?