-হ বইন, আর আহাল অইব না এইবার দেহিস। যা কইলাম যদি না ফলে তহন। কইস, কানা বুড়ী কি কইছিল।
শফির মা’র কুঁচকে যাওয়া শুকনো কালো মুখখানা খুশীতে ভরে ওঠে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে সে মুখখানা দেখে জয়গুনেরও ভরসা হয়। ভবিষ্যদ্বাণীর মতই বিশ্বাস করে শফির মা’র কথাগুলো।
শফির মা বলে—হেই আকালের বচ্ছর পঞ্চাশ সনে দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া ঈদের চান উঠছিল। আমি নিজে দেকছি। চউখ তুহা তাজা আছিল। আমি দেইক্যা কইছিলাম তহন—এইবার না জানি কি আছে কপালে।
—দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া ওঠলে অকাল অইবই। বুড়া-বুড়ীর কাছে হুনছি, দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া চান যদি সমুদ্রের ওপরে নজর দেয়, তয় বান ডাইক্যা দ্যাশ—দুইন্নাই তলাইয়া যায়। দেখলি না অই বাচ্ছর কেমুন–
—কত বচ্ছর পর এইবার সিদা ওঠছে চান। খোদা বাঁচানেওয়ালা।
এফতারের সময় উৎরে গেছে। জয়গুন ঘরের দিকে পা দেয়। মায়মুন বলে—উত্তর মহি কাইত অইয়া ওঠলে কি অয় মা?
—মড়ক লাগে। কলেরা-বসন্ত অয়। মানুষ মইর্যা সাফ অইয়া যায়।
মায়মুন শিউরে ওঠে।
ওজু করে জয়গুন ঘরে যায়। শেষ রোজার ইফতারের জন্য আজ একটু আলাদা আয়োজন—চার ফালি শশা ও এক খোরা গুড়ের শরবত। আর সব দিন এক মগ সাদা পানি সামনে কারে সে বসে থাকত বেলা ডুবে যাওয়া পর্যন্ত! এমন করে খাবার সামনে নিয়ে ইফতারের জন্য বসে থাকা অনেক পুণ্যের কাজ, সে জানে। মসজিদের আজান ইফতারের সংকেত জানালে সে এক ঢোক পানি খেয়ে রোজা ভাঙত।
জয়গুন একচুমুক শরবত খেয়ে মায়মুনের সামনে ঠেলে দেয় বাটিটা। মায়মুন বাটিটা নিয়ে চুমুক দিতেই জয়গুন বলে—মজা পাইয়া বেবাকহানি খাইয়া ফেলাইস না আবার। তোর মিয়াভাইর লাইগ্যা থুইয়া দিস।
শশার এক ফালি মায়মুনের হাতে দিয়ে জয়গুন এক ফালি তুলে নেয়। বাকী দুই ফালি রেখে দেয় হাসুর জন্যে।
শশা চিবোতে চিবোতে সে গত কয়েক বছরের কথা মনে করে। পঞ্চাশ সনের পর থেকে সে এ রকম পুরো তিরিশ রোজা রাখতে পারেনি। চার বছর পর এবার তিরিশ রোজা পুরিয়ে তার মনে শান্তির অবধি নেই। কিন্তু গত বছরগুলির চিন্তাও তাকে পেয়ে বসে। পঞ্চাশ সনে একটা রোজাও রাখা হয়নি। তার পরের বছর ছয়টা, তার পরে পাচটা এবং গত বছর সাতটা রোজা ভাঙা হয়েছে—সে মনে করে রেখেছে! জয়গুন হিসেব করে দেখে, এ কয় বছরে সে দু’ কুড়ি আটটা রোজা ভেঙেছে। নামাজ-রোজা সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি তার জানা। প্রথম স্বামী জরূর মুনশীর দৌলতেই তা সম্ভব হয়েছে। সে জানে, রমজানের একটা রোজা ভাঙলে তার বদলে তিনকুড়ি রোজা রাখতে হয় তবেই গোনা মাফ হয়।
জয়গুন হিসেব করতে চেষ্টা করে। আগেও সে করেছে কয়েকবার। একটা রোজার জন্যে ষাটটা হ’লে দুকুড়ি আটটার জন্য কতদিন রোজা রাখতে হয়। সে হিসেব করতে গিয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলে। একশো পর্যন্ত সে ভালোমত গুনতে পারে না। এককুড়ি’ ‘দুই কুড়ি ‘ করে সে হিসেব করে। সুতরাং সে ক্ষান্ত হয়। কিন্তু তবুও সে আন্দাজ করে নিয়েছে অনেক বছর, হয়ত বা বাকী জীবনভর রোজা রেখেও সে আটচল্লিশ দিনের রোজা শোধ করতে পারবে না। সে আরো জানে, একটা রোজার জন্যে আশী হোক দোজখের আগুনে পুড়তে হবে। এক একটা হোক ইহকালের আশী বছরের সমান।
জয়গুনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে নামাজ সেরে তসবীহ নিয়ে বসে। তসবীহ জুপা এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। তার আবার মনে হয়, কেন? সে-ত জীবনভর রোজা রেখেই চলেছে। রোজা ছাড়া আর কি? বারো মাসের একদিনও সে পেট ভরে খেতে পায় না। ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত আধপেটা খেয়ে থাকে। পেট ভরে কবে সে শুধু দু’টো ভাত খেয়েছে তার মনে পড়ে না। পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্যে ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়, কত বাড়ীতে বাড়ীতে তাকে ঘুরতে হয়েছে। এক বাটি খিচুড়ির জন্যে শারখানায় লাইন ধরতে হয়েছে। কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা আধ-হাঁটু কাদার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়েছে। মাথার ওপর বৃষ্টি পড়েছে, রোদ জ্বলেছে। তার বেশী জ্বলেছে পেটের মধ্যে। যখন যেখানে যতটুকু পেয়েছে, খেয়েছে। পেট ভরেনি। পানি খেয়ে খেয়ে পেট ভরেছে। তার পরের বছরগুলিও চলেছে অতি কষ্টে। ছেলেমেয়েকে খাইয়ে কতদিন উপোস করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে সারারাত সারাদিন কেটেছে একটা দানাও পড়েনি পেটে। রমজান মাসের রোজার চেয়েও যে ভয়কর এ রোজা। রমজানের একমাস দিনের বেলা শুধু উপোস। কিন্তু তার বারোমেসে রোজার যে অন্ত নেই।
কিন্তু তবুও জয়গুনের শান্তি নেই, সাত্বনা সে পায় না। তার অন্যায়ের জন্য সে খোদার। কাছে প্রার্থনা করে।
হাসু আসে রাত আটটায়। মোট বয়ে বারো আনা পেয়ে সে চার আনা দিয়ে একটা নারকেল নিয়ে আসে। জয়গুন দেখে রাগ করে—তোর আর আৰুল অইব কোনদিন! অত পয়সার নাইকল কিনতে গেলি ক্যান?
—ঈদের দিন এট্টু শিন্নিও খাই না?
—নাইকল বেগর আর শিন্নি অয় না! নোয়াবের পো নোয়াব! নাইকল বেগরই – পাকাইমু আমি। অইড়া বেইচ্যা ফালাবি কাইল।
হাসু ক্ষুণ্ণ হয়। বলে—থাউক আর শিন্নি রানতে অইব না, পান্তা ভাত আর মরিচ-পোড়া – খাওয়া কপাল। বচ্ছরের একটা দিন আর শিন্নি খাইয়া কি অইব!
জয়গুন চুপ করে। খানিক পরে আবার বলে—পরাণে খাইতে চায়, খাও। পয়সা কামাই করবা, খাইবা, আমার কি? দুই দিন বাদে যহন হকাইয়া তেজপাতা হইয়া যাইবা, তহন বোঝবা শিন্নির মজা!