কিয়ের ডর, অ্যা ব্যাডা! এহন ভাটা লাগছে। বেশি নিচে যাওন লাগব না।
ফেকুও গামছা পরে পানিতে নামে। জালের সুতলি ধরে দুজনেই ডুব দেয়। একটু পরে গোতলাগুতলি করে দু’জনই ভেসে ওঠে। ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে কেরামত বলে, একটা মানুষ!
জঙ্গুরুল্লা এটাই অনুমান করেছিল। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে, মানুষ! কেরে মানুষটা? মাথাডা উড়াইয়া দ্যাখ দেখি।
আমার ডর লাগে। কেরামত বলে।
দুও ব্যাডা। কিয়ের আবার ডর?
নৌকার বাকি তিনজন তাজু, মেছের ও দূরবক্সকে নাম ধরে ডেকে বলে, তোরা তিনজনও পানিতে নাম। বেবাকে মিল্যা মাথাডা উপরে উড়া। কিন্তু সাবধান। লাশটা যেমুন অবস্থায় আছে তেমুনই রাইখ্যা দিতে অইব। বেশি লাড়াচাড়া দিলে স্রোতে টাইন্যা লইয়া যাইব গা।
দাঁড়ী তিনজন পানিতে নামে।
মাথাডা কুনখানে আছে আগে আতাইয়া ঠিক কইর্যা ল।
কোমর-পানিতে দাঁড়িয়ে তারা আলগোছে লাশের মাথাটা উঁচু করে।
আরে! এইডা দেহি হেকমইত্যা চোরা! তিন-চারজন এক সাথে কলবল করে ওঠে।
হেকমইত্যা চোরা! ওর বাড়ি কই? জঙ্গুরুল্লা জিজ্ঞেস করে।
এইতো কাছেই পুবদিগে, নয়াকান্দি। নূরবক্স বলে।
ওর বাড়িতে কে আছে?
আছে ওর মা আর বউ। আর কেও নাই। কাইল বিয়ালে ওরে দিঘিরপাড় দেখছিলাম। ফজল মাতবরের লগে তার নায় উইট্টা বাড়িত গেল।
জঙ্গুরুল্লার মনে হঠাৎ খুশির বান ডাকে। আনন্দের আতিশয্যে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আর মনে মনে আল্লার শোকরগুজারি করে। আজই ভোরে মাত্র কিছুক্ষণ আগে আল্লার সাহায্য প্রার্থনা করে সে মোনাজাত করেছিল। যে ওজু করে সে মোনাজাত করেছিল সে ওজু নষ্ট হওয়ার আগেই তার মোনাজাত কবুল হয়েছে পরম দয়ালু আল্লার দরবারে। এত তাড়াতাড়ি এত তনগদ আল্লা তার মকসেদ পুরা করবে সে তা ভাবতেই পারেনি।
জঙ্গুরুল্লা তার মনের উল্লাস মনেই চেপে রেখে বলে, এই নূরবক্স, তুই ঠিক দ্যাখছস তো? ঐ নায় আর কে কে আছিল?
আর আছিল নাগরার চরের চান্দু। আর একজনরে চিনি নাই।
ওগ আর কে কে দ্যাখছে?
ঐ সময় দিঘিরপাড় নৌকা ঘাডে যারা আছিল, অনেকেই দ্যাখছে।
তোরা বোঝতে পারছস ঘটনাডা কি?
সবাই তার মুখের দিকে তাকায়।
ঘটনাডাতো আয়নার মতন পরিষ্কার। খুন কইর্যা ঐখানে ফালাইয়া গেছে।
খুন! কারা খুন করছে। বিস্মিত প্রশ্ন সকলের।
হেইডাও বুঝলি না? নূরবক্স কি কইল? কারা ওরে নায়ে কইর্যা লইয়া গেছিল?
ওরা পানি থেকে নৌকায় উঠতেই জঙ্গুরুল্লা বলে, আরে তোরা উইট্যা গেলিনি। এই ফেকু, তুই আবার পানিতে নাম। জালডা মনে অয় কোমরে বান্দা আছে। জাল খুইল্যা আন। মাছগুলা ফালাইয়া দে।
ফেকু ডুব দেয়। জালের সুতলি ধরে ধরে নিচে যায়। কিন্তু সুতলিটা যেখানে গিঠ দিয়ে বাঁধা সেখানে তার হাত যায় না। গিঠটা উপুড়-হয়ে-পড়ে-থাকা লাশটার পেটের দিকে তাগার সাথে। ভয়েই সে আর ওদিকে হাত বাড়ায় না। সে ওপরে উঠে দম নিয়ে আবার ডুব দেয়। দাঁত দিয়ে সুতলিটা কেটে সে জালটা তুলে নিয়ে আসে। মাছগুলোকে জঙ্গুরুল্লার নির্দেশ মতো সে স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।
জঙ্গুরুল্লা চারদিকে তাকায়। দূর দিয়ে দু-একটা নৌকা যেতে দেখা যায়। ধারে কাছে কেউ নেই। একটু পরেই লোকজনের ভিড় জমে যাবে।
ও তাজু, ও ফেকু, তোরা পাড়ে নাইম্যা থাক। জঙ্গুরুল্লা নির্দেশ দেয়। তোরা পাহারা দিবি। আরেকটু পরে খবর পাইয়া মানুষজন আইস্যা ভিড় জমাইব। খবরদার, কাউরে পানি নামতে দিবি না। আমরা থানায় খবর দিতে যাইতে আছি। পুলিস আইয়া লাশ উডাইব।
গলা খাদে নামিয়ে সে আবার বলে, তোরা শোন, চিলের কথা, জালের কথা কিন্তু কারো কাছে কইবি না, খবরদার!
তাজু ও ফেকু নৌকা থেকে কিছু মুড়ি ও বাতাসা নিয়ে নেমে যায়। পানসিটা রওনা হয় হেকমতের বাড়ির দিকে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় দূরবক্স।
রাত না পোহাতেই জরিনাকে নিয়ে নাজুবিবি হেকমতের খোঁজে এলাকার চৌকিদারের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু চৌকিদার কোনো খোঁজই দিতে পারেনি। ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ গলা খাকারি শুনে তারা হকচকিয়ে যায়।
কে আছে বাড়িতে? অপরিচিত ভারী গলায় জিজ্ঞেস করছে কেউ।
এইতো আমরা আছি। কেডা জিগায়? নাজুবিবি পাল্টা প্রশ্ন করে।
নূরবক্স পা চালিয়ে নাজুবিবির কাছে যায়। নিচু গলায় সে জঙ্গুরুল্লার পরিচয় দেয়।
ও, পা-না-ধোয়া…
চুপ, চুপ! নূরবক্স মুখে আঙুল দিয়ে সতর্ক করে দেয় নাজুবিবিকে। কও চদরী সাব।
আহেন চদরী সাব। নাজুবিবি সাদর আহ্বান জানায়।
জঙ্গুরুল্লা এসে উঠানে দাঁড়ায়।
জরিনা পিড়ি এনে শাশুড়ির হাতে দেয়। সে ওটা পেতে দিয়ে বলে, গরিবের বাড়ি হাতির পাড়া। বহেন চদরী সাব।
না বসনের সময় নাই। তুমিই হেকমতের মা?
হ, হেকমতের কোনো খবর লইয়া আইছেন?
হ।
কি খবর? জলদি কইর্যা কন। আমরা তো চিন্তায় জারাজারা অইয়া গেছি।
খবর শোনার পরের পরিস্থিতিটা আঁচ করতে পারে জঙ্গুরুল্লা। সে বলে, খবর পরে অইব। তুমি আর তোমার পুতের বউ চলো আমাগ লগে নৌকায়। থানায় যাইতে অইব।
থানায়! ওরে কি থানায় বাইন্দা লইয়া গেছে?
পরেই শুনতে পাইবা। এহন তোমরা তৈরি অইয়া লও জলদি।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাজুবিবি ও জরিনা জঙ্গুরুল্লার পানসিতে উঠে বসে।
সরু একটা সেঁতা দিয়ে কিছুদূর ভাটিয়ে পানসিটা গুনগার খাড়িতে গিয়ে পড়ে। জঙ্গুরুল্লার নির্দেশে ডানদিকে মোড় নিতেই বাঁদিকে লোকজনের ভিড় দেখা যায়।