জঙ্গুরুল্লার সব চিন্তার বড় চিন্তা কি ভাবে ফজলকে জব্দ করা যায়। তার সব কাজের বড় কাজ–কোন্ ফিকিরে ওকে আবার জেলে ঢোকানো যায়।
হঠাৎই একটা সুযোগ পেয়ে যায় সে। সুযোগ নয়, সে এক মহাসুযোগ। এ যেন রূপকথার মোহরভরা কলসি। হাঁটতে হাঁটতে তার ঘরে এসে হাজির।
পীরবাবা ভাগ্যকূল এসেছেন–খবর পায় জহুরুন্না। তাকে আবার কোন মুরিদ দখল করে ফেলে তার কি কোনো ঠিক আছে? এটাও চর দখলের মতোই দুরূহ কাজ।
খবর পাওয়ার পরেই দিনই মোরগের বাকের সময় সে পানসি নিয়ে ভাগ্যকূল রওনা হয়। পানসি বাওয়ার জন্য তিনজন বাঁধা আছে–একজন হালী ও দু’জন দাঁড়ী। এছাড়াও অতিরিক্ত দু’জন দাড়ী সে সাথে নেয়। যাওয়ার সময় উজান ঠেলে যেতে হবে। বছরের এ সময়ে বাতাস কম। তাই পাল না-ও খাটতে পারে। হয়তো সবটা পথ দাঁড় বেয়ে, গুন টেনে যেতে হবে।
পানসিতে উঠেই জঙ্গুরুল্লা ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে। নামাজের শেষে হাত উঠিয়ে সে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করে। মোনাজাতের মধ্যে সে আল্লার কাছে অনেক কিছু প্রার্থনা করে। অনেক কিছুর মধ্যে দুটো ব্যাপারে সে বারবার পরম দয়ালু আল্লার সাহায্য প্রার্থনা করে, …ইয়া আল্লাহ, এরফান মাতব্বরের পোলা ফজলরে শায়েস্তা করার বুদ্ধি দ্যাও, শক্তি দ্যাও, সুযোগ দ্যাও। ইয়া আল্লাহ, থানার বড় দারোগা আমার উপরে বড় রাগ, বড় খাপ্পা। ইয়া আল্লাহ, তারে অন্য থানায় বদলি কইর্যা দ্যাও। রাব্বানা আতেনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখেরাতে হাসানাতাও ওয়াকেনা আজাব আনার। আমিন।
জঙ্গুরুল্লা খাস খোপ থেকে বেরিয়ে ছই-এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
ফরসা হয়ে গেছে চারদিক। রক্তরাঙা গোলাকার সূর্য দিগ্বলয় ছাড়িয়ে উঠে গেছে। শিশির ভেজা ধানের শিষ আর কাশফুল মাথা নুইয়ে ভোরের সূর্যকে প্রণাম করছে, স্বাগত জানাচ্ছে। ঝিরঝিরে বাতাসের স্পর্শে শিহরিত রূপালি পানি কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে। উজান ঠেলে, ভাটি বেয়ে বিভিন্ন মোকামের ছোট বড় নানা গড়নের খালি বা মালবোঝাই নৌকা চলাচল করছে। দুটো গাধাবোট টেনে নিয়ে একটা লঞ্চ উত্তরের বড় নদী দিয়ে পুবদিকে যাচ্ছে।
জঙ্গুরুল্লার পানসি গুনগাঁর খাড়িতে ঢোকে। কেরামত হাল ধরে আছে। বাকি চারজন টানছে দাঁড়। কুলোকেরগাও বাঁয়ে রেখে, ডাইনগাও ডানে রেখে পানসিটা উত্তর-পশ্চিম কোনাকুনি বড় নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গুরুল্লা ডান দিকে তাকায়। ডাইনগাঁয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। সে আবার বাঁ দিকে তাকায়। কুলোকেরগাও বড় হচ্ছে পলি পড়ে।
সামনে ডানদিকে বেশ কিছু দূরে দুটো চিল শূন্যের ওপর মারামারি খামচাখামচি করতে করতে নিচে পড়ে যাচ্ছে। ও দুটো পানিতেই পড়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু গায়ে পানি লাগার আগেই একটা চিল রণে ভঙ্গ দিয়ে উড়ে পালায়। তার পিছু ধাওয়া করে অন্যটা। কিছুদুর পর্যন্ত তাড়া করে বিজয়ী চিলটা ফিরে যায় পাড়ের কাছের সেই জায়গাটায়।
কেরামতের চোখের সামনেই ঘটছে চিলের মারামারি। সে উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে চিল দুটোর গতিবিধি।
চিলটা পানির ওপর তীক্ষ্ণ লোলুপ দৃষ্টি ফেলে চক্কর দিচ্ছে আর ছো মারার জন্য তাওয়াচ্ছে। মনে হয় এখনি ছোঁ মারবে। হটে যাওয়া চিলটা ওখানেই যাচ্ছে আবার। বিজয়ী চিলটা আবার ওটাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে যায় সে জায়গায়।
কেরামত ঠিক বুঝতে পারে না, নদীতে এত জায়গা থাকতে দুটো চিলেরই রোখ ঐ এক জায়গায় কেন? মাছের খনি আছে নাকি ওখানে?
জায়গাটার কাছাকাছি পশ্চিম দিক দিয়ে এখন যাচ্ছে পানসিটা।
চিলটা ছোঁ মারে হঠাৎ। নখরে বিধিয়ে কী নিয়ে উঠছে ওটা? আরে, একটা জাল যে! জালের একটা মাছওতো বিধে আছে নখরে!
হুজুর দ্যাহেন দ্যাহেন চাইয়া দ্যাহেন চিলের কাণ্ড! বিস্মিত কেরামত এক নিশ্বাসে বলে।
জঙ্গুরুল্লা দেখে, একটা চিল জালের মাছ নখরে বিধিয়ে জালসহ ওপর দিকে পাখা ঝাঁপটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। জালের এক প্রান্তে বাধা সুতলির কিছুটা ওপরে উঠে গেছে জালের সাথে। সুতলির আর এক প্রান্ত নিশ্চয়ই পানির নিচে কোনো কিছুর সাথে বাঁধা আছে–ভাবে জঙ্গুরুল্লা। তাই জালটা ওপরে টেনে তুলতে পারছে না চিলটা। জালের ভেতর কয়েকটা মাছও দেখা যাচ্ছে। বিতাড়িত চিলটা এদিকে আসছে আবার। ওটা জালের মাছের ওপর থাবা দেয়ার উপক্রম করতেই দখলদার চিলটা জালসহ মাছ ছেড়ে দিয়ে ওটার পেছনে ধাওয়া করে। জালটা ধপ করে পানিতে পড়ে যায়।
এই কেরা, নাও ভিড়া জলদি। জালডা কিয়ের লগে বান্দা আছে, দ্যাখন লাগব।
কেরামত ও দাড়ীরা সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে জঙ্গুরুল্লার দিকে তাকায়।
আরে চাইয়া রইছস ক্যান? ত্বরাতৃরি কর।
কেরামত নৌকা ঘুরিয়ে কিনারায় জালটার কাছে নিয়ে যায়।
স্রোতের টানে জালটা ডুবে যাচ্ছে, আবার ওটার এক প্রান্ত ভেসে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। কয়েকটা মরা পেট-ফোলা মাছ চিৎ হয়ে আছে জালের মধ্যে।
এই কেরা, কিনারে নাও বাইন্দা রাখ। ভালো জাগায় বান্দিস। পাড় ভাইঙা যেন না পড়ে।
কেরামত পাড়া গেড়ে নৌকা বাঁধে কিনারায় ।
এই কেরামত, পানিতে নাম। জালের সুতলি ধইর্যা ডুব দেয়। দ্যাখ জালডা কিয়ের লগে বান্দা।
কেরামত গামছা পরে পানিতে নেমে বলে, এই ফেকু, তুইও আয়। একলা ডর করে।