মাছগুলোকে ধপাত্ করে মাটিতে ফেলে ফজল ডিঙিতে উঠেছিল আবার ডিঙি ছুটিয়ে হাশাইলের বাজার থেকে মাছ-বেচা পয়সায় কিনে এনেছিল ছয় সের চাল।
তারপর থেকে মাছ বেচা পয়সায় সংসারের আংশিক খরচ চলছে। ফজলের বাবা-মা প্রথম দিকে আপত্তির ঝড় তুলেছিল। অভাবের তাড়নায় সে ঝড় এখন শান্ত হয়ে গেছে।
মাছের গোনা-বাছা শেষ করে ফজল। মাছের গায়ের লালায় তার হাত দুটো চটচট করে। হাত ধুয়ে সে গামছায় মোছে। তারপর গলুইয়ে গিয়ে মাথির চরাট সরিয়ে বের করে বিড়ি আর ম্যাচবাতি।
অত কিনার চাপাইয়া ধরছস ক্যান্ নূরু? সামনে ফিরা আওড়। আরো মাঝ দিয়া যা।
নুরুকে সাবধান করে দেয় ফজল। কিনার ঘেষে কিছুদুর গেলেই আবর্ত। সেখানে স্রোত বইছে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে পড়লে নৌকা সামলানো সম্ভব হবে না ছোট ছেলেটির পক্ষে। এক ঝটকায় তাদের নৌকা বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাবে অনেক দূর।
নূরু নৌকা সরিয়ে নিয়ে যায় কিনারা থেকে দূরে। মাঝের দিকে সোতের টান বেশি তরতর করে এগিয়ে যায় নৌকা।
ফজল এবার বিড়ি ধরিয়ে মাথিতে চেপে বসে। সে বিড়িতে লম্বা টান দেয় আর মুখ ভরে ধোয়া ছাড়ে।
দূরে নদীর মাঝে সাদা সাদা দেখা যায়, কি ওগুলো?
ফজল চেয়ে থাকে। তার চোখে পলক পড়ে না। ঐখানেই বা ওর আশেপাশে কোথাও ছিল তাদের খুনের চর।
নূরুকে সরিয়ে বৈঠা হাতে নেয় ফজল। জোর টানে সে নৌকা ছোটায় পুব-উত্তর কোণের দিকে।
কিছুদূর গেলেই সাদা বস্তুগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।
কি আশ্চর্য! নদীর মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বক।
ফজল বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু দেখবার জন্য সে উত্তর দিকে তাকায়। হ্যাঁ ঐ তো, ঐ-তো বানরির জোড়া তালগাছ!
উল্লসিত হয়ে ওঠে ফজল। বলে, চর জাগছেরে নূরু, চর জাগছে!
কই, কই?
ঐ দ্যাখ, ঐ যে ঐ।
বকগুলো আঙুল দিয়ে দেখায় ফজল।
আনন্দে লাফিয়ে ওঠে নূরু। সে দেখতে পায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে বকগুলো। মাছ ধরার জন্য গলা বাড়িয়ে আছে। লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারছে মাঝে মাঝে।
এইডা কি আমাগ চর, দুদু?
হরে হ। আমাগ খুনের চর। ঐ দ্যাখ, ঐযে দ্যাখা যায় বানরির জোড়া তালগাছ। ছোডকালে আমরা যখন ঐ চরে যাইতাম তখন সোজা উত্তরমুখি চাইলে দ্যাখা যাইত আসুলির ঐ উঁচা তালগাছ দুইডা।
ফজল বকগুলোর দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, নূরু, তুই বৈঠা আতেল। টান দে জোরে, বকগুলোরে দেখাইয়া দেই।
ক্যান্ দুদু?
এখনো কেও টের পায় নাই। বক দেখলেই মাইনষে টের পাইয়া যাইব, চর জাগছে।
চাচা-ভাইপো বৈঠা টেনে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গেলেই বৈঠা ঠেকে মাটির সাথে।
আর আউগান যাইবনারে নূরু, চড়ায় ঠেইক্যা যাইব নাও। মাডিতে নাও কামড় দিয়া ধরলে মুশকিল আছে। তখন দুইজনের জোরে ঠেইল্যা নামান যাইব না।
বৈঠাটানা বন্ধ করে দুজনেই। বকগুলো এখনো বেশ দূরে। ফজল পানির ওপর বৈঠার বাড়ি মারে ঠপাস-ঠপাস। কিন্তু বকগুলো একটুও নড়ে না। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এত দূরের শত্রুকে ভয় করবার কিছু নেই।
ফজল আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায় নৌকা। কিন্তু কিভাবে তাড়াবে বক? মারবার মতো একটা কিছু পেলে কাজ হত।
হঠাৎ ফজলের নজর পড়ে বেলে মাছগুলোর ওপর। সে ডওরা থেকে একটা বেলে মাছ নিয়ে জোরে বকগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে। বকগুলো এবার উড়াল দেয়। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার নেমে পড়ে চরে।
বকগুলোতো বড় বজ্জাতরে। এইখানে মাছ খাইয়া জুত পাইয়া গেছে। অত সহজে যাইব না।
দুদু, পানিতো এটটুখানিক, আমি নাইম্যা গিয়ে দেখাইয়া দিয়া আহি?
নারে, তুই পারবি না। কাফালের মইদ্যে পইড়া যাবি।
ফুঁত্-ফুঁত্।
স্টিমারের ফুঁ শুনে ফজল ও নূরু তাকায়। চাটগাঁ মেল আসছে। সামনে নৌকা পড়েছে। বোধ হয়। তাই ফুঁত্-ফুঁত্ শব্দ করল দু’বার।
ফজল বলে, খাডো চুঙ্গার জাহাজ। শুয়োরের মতোন ‘গ’ দিয়া আইতে আছেরে! শিগগির টান দে নূরু। নাওডা সরাইয়া লইয়া যাই। চড়ার উপর ঢেউয়ে আছাড় মারব।
নৌকা নিয়ে সরে যায় তারা। তাদের অনেক দূর দিয়ে নতুন চরেরও উত্তর পাশ দিয়ে স্টিমার চলে যায়। তার চলার পথের আন্দোলিত পানি ঢেউ হয়ে ছুটে আসছে। ফজল ঢেউ বরাবর লম্বিয়ে দেয় নৌকা, শক্ত হাতে হাল ধরে। নূরুকে বলে, তুই বৈডা থুইয়া দে নূরু। শক্ত কইর্যা পাডাতন ধইর্যা থাক। উজান জাহাজে ঢেউ উঠব খুব।
ডলে-মুচড়ে উঁচু হয়ে ঢেউ আসছে। বিপদ বুঝে বকগুলো এবার উড়াল দেয়।
দ্যাখ দ্যাখ নূরু। ঐ দ্যাখ, বকগুলো উড়াল দিছে।
বকগুলোর অবস্থা দেখে নূরুর হাসি পায়। সে বলে, এইবার। এইবার যাও ক্যান্? ঢেউয়ের মইদ্যে ডুবাইয়া ডুবাইয়া মাছ খাও এইবার।
বকগুলো ওপরে উঠে দু-একবার এলোমেলো চক্কর দেয়। নিচে ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে নামবার আশা ছেড়ে দেয় ওরা। তারপর ঝাক বেঁধে পশ্চিম দিকে উড়ে চলে যায়।
ঢেউয়ের বাড়িতে ওঠানামা করছে নৌকার দুই মাথি। এক মাথিতে ফজল, অন্য মাথির ঠিক নিচেই পাটাতন ধরে বসে আছে নূরু। ফজল বলে, নূরু, সী-সঅ, সী-সঅ, কিরে ডর লাগছে নি? সী-সঅ, সী-সঅ।
ঢেউ থামলে নূরু বলে, সী-সঅ কি দুদু?
সী-সঅ একটা খেইল। বাচ্চারা খেলে। নারাণপুর চৌধুরী বাড়ি খাজনা দিতে গেছিলাম। সেইখানে দেইখ্যা আইছি।
একটু থেমে সে আবার বলে, আইজ আর নিকারির টেঁকে যাইমু নারে।