ফজল বলে, মাছটা খুব বুড়ারে। তেল অইছে খুব। এইডার পেডির মাছ যে গালে দিব, বুঝব মাছ কয় কারে! মাইনষে কি আর খামাখা কয়–পক্ষীর গুড়া আর মাছের বুড়া, খায় রাজা আঁটকুড়া।
মাছ ধরা শেষ হয়েছে। এবার বেচবার পালা। নূরুকে বলতে হয় না। সে নৌকার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নিকারির টেকের দিকে। ভাটির টানে ছুটছে নৌকা। নূরু হালটা চেপে ধরে বসে থাকে মাথিতে। ফজল তার হাতের বৈঠা রেখে মাছগুলো বাছতে শুরু করে। আকার অনুযায়ী সে হালি ঠিক করে রাখে। গোটা দশেক টাটকিনি আর ছ’টা গলদা চিংড়ি বাদে সবগুলোই বেচে দিতে হবে। বড় পাঙাশ মাছটা নিজেদের জন্য রাখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা হলে বাকিগুলোয় আর কটা পয়সাই আসবে। সের চারেক ওজনের পাঙাশ মাছটায় কমসে কম বারো গণ্ডা পয়সা পাওয়া যাবে। ঘরে চাল নেই। তেল-নুন আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। শুধু মাছ খেয়ে তো আর পেট ভরবে না। মাছটার দামে কেনা যাবে দশসের চাল– সংসারের চারদিনের খোরাক।
গত তিন বছর ধরেই টানাটানি চলছে সংসারে। ডিঙ্গাখোলা আর লক্ষ্মীচর ভেঙে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে এ দুর্দিন। এই দুই চরে অনেক জমি ছিল তাদের। বছরের খোরাক রেখে অন্তত পাঁচশ টাকার ধান বেচতে পারত তারা। প্রতি বছর পাট আর লটা ঘাসে আসত কম করে হলেও হাজার টাকা। পদ্মার অজগরস্রোত গিলে খেয়েছে, উদরে টেনে নিয়েছে সব জমি। গুণগার নমকান্দি থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙা। তারপর বিদগাঁও কোনা কেটে, দিঘলির আধাটা গিলে, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা, লক্ষ্মীচর আর মূলভাওরকে বুকে টেনে চররাজাবাড়ির পাশ কেটে উন্মাদিনী পদ্মা গা দোলাতে দোলাতে চলে গেছে পুব দিকে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এঁকেবেঁকে চলেছে ডানে আর বাঁয়ে।
চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।
এরফান মাতব্বরের বাড়ি ছিল লক্ষ্মীচরে। এগারো বছর কেটেছিল সেখানে। এ এগারো বছরের আয়ু নিয়েই জেগেছিল চরটা। মেয়াদের শেষে পদ্মা গ্রাস করেছে। এই নিয়ে কতবার যে লক্ষ্মীচর জেগেছে আর ভেঙেছে তার হিসেব রাখেনি এরফান মাতব্বর। সে ঘর-দোর ভেঙে, পরিবার-পরিজন, গরু-বাছুর নিয়ে ভাটিকান্দি গিয়ে ওঠে। দুটো করে টিনের চালা মাটির ওপর কোনাকুনি দাঁড় করিয়ে খুঁটিহীন কয়েকটা দোচালা তৈরি হয় মামাতো ভাইয়ের বাড়ির পাশে। মাতব্বরের সংসার এভাবে ‘পাতনা দিয়ে ছিল বছর খানেক। তারপর ঐ চরেই জায়গা কিনে বছর দুয়েক হলো সে আবার বাড়ি করেছে।
ফজল আগে শখ করে মাছ ধরতে যেত। মাছ ধরাটা ছিল তখন নেশার মতো। এখন অনেকটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপজীবিকার আশ্রয় না নিয়ে উপায় ছিল না। সংসারে খাবার লোক অনেক। সে তুলনায় এখন জমির পরিমাণ সামান্য। চরদিঘলিতে মাত্র কয়েক নল জমি আছে তাতে যে ধান হয় তাতে টেনেটুনে বছরের চারমাস চলে। বাকি আটমাসের পেটের দায় ছাড়াও খাজনা রয়েছে। চর থাকুক আর না থাকুক জমিদারের নায়েবরা খাজনার টাকা গুনবেই। নয়তো তাদের কোনো দাবিই থাকবে না যদি আবার কখনো চর জেগে ওঠে সে এলাকায়।
ফজল লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ বেচে। গেরস্তের ছেলের পক্ষে মাছ-বেচা নিন্দার ব্যাপার। আত্মীয়-কুটুম্বরা জানতে পারলে ছি-ছি করবে। হাসাহাসি করবে গাঁয়ের লোক। দুষ্ট লোকের মুখে মুখে হয়তো একদিন মালো বা নিকারি খেতাব চালু হয়ে যাবে।
দিনের পর দিন অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল। মাছ বেচার কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি ফজল। শখ করে একদিন সে লেদ বড়শি নিয়ে নদীতে গিয়েছিল। বড়শিতে উঠেছিল একটা মস্ত বড় আড় মাছ। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নিকারি-নৌকা। মাছ দেখে ডাক দেয় মাছের ব্যাপারি, ও ভাই মাছটা বেচুবানি?
ফজল কৌতুক বোধ করে। মজা করবার জন্য উত্তর দেয় সে, হ বেচুম। কত দিবা?
তুমি কত চাও?
এক টাকা।
এক টা–কা! মাছখানের লগে নাওখান দিবা তো?
উঁহু, বৈডাখান দিমু।
বোঝলাম, বেচনের মত নাই তোমার। বেচতে চাও তো উচিত দাম কইয়্যা দ্যাও।
তুমিই কও।
আটআনা দিমু।
আট আনা!
পয়সার অঙ্কটা মধুর লাগে ফজলের কানে। লোভ হয় তার। পয়সার অভাবে তিনদিন ধরে একটা বিড়ির মুখ দেখেনি সে।
সে এদিক ওদিক তাকায়। না, ধারে কাছে কেউ নেই। নিকারি-নৌকাটা ভাটিয়ে গিয়েছিল কিছুদূর। ফজল ডাক দেয়, ও ভাই, আইও লইয়া যাও।
নিকারি নৌকায় মাছটা তুলে দিয়ে আট আনা গুনে নেয় ফজল। তার মাছ বেচার বউনি হয় এভাবে।
সেদিন কয়েকটা ছোট ছোট শিলন, ট্যাংরা মাছও পেয়েছিল ফজল। সেগুলো নিয়ে যখন সে বাড়ি আসে তখন মা চেঁচিয়ে ওঠে, মাছ খাইলেই দিন যাইব আঁ? এতদিন বীজ-ধান ভাইন্যা খাওয়াইছি। দেহি আইজ খাওয়ন আহে কইতন।